TV9 Explained: দুয়ারে রেশনে কেন আপত্তি ডিলারদের? রাজ্য কেন পক্ষে? কী বলছে আইন?

Duare Ration Explained: রেশন ডিলারদের পক্ষ থেকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে এই নিয়ে রিভিউ পিটিশন জমা দেবেন। ফলে সুপ্রিম স্থগিতাদেশে আপাতত দুয়ারে রেশন চালু করা গেলেও, আইনি জাঁতাকল রয়েই যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা আসলে কোথায়? কী নিয়ে সংঘাত রাজ্য ও রেশন ডিলারদের?

TV9 Explained: দুয়ারে রেশনে কেন আপত্তি ডিলারদের? রাজ্য কেন পক্ষে? কী বলছে আইন?
দুয়ারে রেশন
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Dec 02, 2022 | 4:56 PM

কলকাতা: দুয়ারে রেশনের (Duare Ration) ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী রয়েছে জানা নেই। রেশন ডিলারদের সংগঠনের সঙ্গে রাজ্যের সংঘাত চলছে। আদালতে মামলা চলছে। তবে আপাতত সুপ্রিম কোর্টের (Supreme Court) নির্দেশে খানিক স্বস্তি পেয়েছে নবান্ন। কলকাতা হাইকোর্ট (Calcutta High Court) দুয়ারে রেশন বন্ধ করার যে নির্দেশ দিয়েছিল, তাতে স্থগিতাদেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। ফলে পরবর্তী কোনও নির্দেশ না আসা পর্যন্ত দুয়ারে রেশন চালিয়ে যেতে পারবে রাজ্য। এদিকে রেশন ডিলারদের পক্ষ থেকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে এই নিয়ে রিভিউ পিটিশন জমা দেবেন। ফলে সুপ্রিম স্থগিতাদেশে আপাতত দুয়ারে রেশন চালু করা গেলেও, আইনি জাঁতাকল রয়েই যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা আসলে কোথায়? কী নিয়ে সংঘাত রাজ্য ও রেশন ডিলারদের?

দুয়ারে রেশন প্রকল্প কী?

সাধারণ মানুষের কাছে রেশনিং ব্যবস্থা আরও সহজলভ্য করার জন্য দুয়ারে রেশন প্রকল্প চালু করে রাজ্য সরকার। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যবাসীর কাছে যে যে প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হল এটি। তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসার পর, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন মমতা। গতবছরের ১৬ নভেম্বর থেকে রাজ্যে শুরু হয় দুয়ারে রেশন প্রকল্প। রেশন দোকানে যেমন রেশন সামগ্রী পাওয়ায় যাচ্ছিল, তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে রেশন সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই প্রকল্পের মাধ্যমে।

কোথায় সমস্যা?

বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই দুয়ারে রেশন ব্যবস্থা চালু করার পর থেকেই বেশ কিছু জায়গায় সমস্যা। বেঁকে বসতে শুরু করেন রাজ্যের রেশন ডিলারদের একাংশ। বাড়ি বাড়ি রেশন পৌঁছে দেওয়ার এই প্রকল্পের বিরোধিতা করতে থাকেন ডিলারদের একাংশ। বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত।

কী বক্তব্য রেশন ডিলারদের? কোথায় আপত্তি?

রেশন ডিলারদের একাংশ দুয়ারে রেশন প্রকল্প তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। প্রথমত, রাজ্য সরকার যে প্রকল্প চালু করেছে, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একাধিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন তাঁরা। রাজ্যে দুয়ারে রেশন চালু করার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই বলে দাবি তাঁদের। যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, তা বর্তমান পরিস্থিতিতে নেই বলেই জানাচ্ছেন বেঁকে বসা রেশন ডিলাররা। সমস্যা আরও রয়েছে, যেদিন দুয়ারে রেশন প্রকল্পের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেশন দিতে হবে, সেদিন রেশন দোকান বন্ধ রাখতে হবে। ফলে অনেক মানুষ, যাঁরা সেদিন রেশন দোকানে আসবেন, তাঁদের পরিষেবা দেওয়া যাবে না।

দ্বিতীয়ত, রেশন সামগ্রী বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়ির প্রয়োজন। এক্ষেত্রেও রাজ্য সরকার গাড়ি কেনার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রেশন ডিলারদের একাংশের। শুধু তাই নয়, সেই গাড়ি কোথায় রাখা হবে, সেই জায়গার ব্যবস্থা করাও একটি ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার বলে মনে করছেন তাঁরা। সবথেকে বড় যে বিষয়টিতে আপত্তি রেশন ডিলারদের, তা হল এই দুয়ারে রেশন প্রকল্প নাকি জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন, ২০১৩-র সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যদি চালু রাখতেই হয়, তাহলে সংশোধন করা হোক আইন। এই সব দাবি দাওয়ার কথা তুলে ধরেই আদালতের দ্বারস্থ হন তাঁরা।

কী বলছে রাজ্য?

সোমবার সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ আসার পর রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষ অবশ্য বলছেন, “অধিকাংশ ডিলার দুয়ারে রেশন প্রকল্পের সঙ্গেই ছিলেন। কিছু ডিলার বানচাল করতে আদালতে যায়। প্রগ্রেসিভ রিফর্মস করতে বাধা নেই। আমরা কিন্তু কিছু বাদ দিতে বলিনি। দোকান ও বাইরে দু’জায়গায় থেকে পাওয়া যাবে। আমরা আলাদা এজেন্সি করিনি। প্রায় ৭৫ টাকা প্রতি কুইন্টালে ও ৫০০০ টাকা ফিক্সড ইনসেনটিভ দিয়েছি। এছাড়া গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে আমরা টাকা দিয়েছিলাম। আমরা সব সাহায্য করতে চেয়েছি। আশা করি রেশন ডিলাররা এগিয়ে আসবে। আমরা আইনের পরিপন্থী নই। ডিলারদের অভিযোগ সঠিক ছিল না।”

তিনি আরও বলেছিলেন, সরকারের ভাবনা যা ছিল তাই থাকবে। ডিলারদের অনুরোধ নতুন করে সংঘাতে যাবেন না। অসুবিধা হলে আমাদের জানান। সরকারের ঘোষিত কর্মসূচী এইভাবে বানচাল করা যায় না। সব গ্রামে আমাদের দোকান নেই। তাই দুয়ারে রেশন প্রকল্প আমাদের চালাতে হবেই।”

রাজ্যের তরফে যে যে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে

এই দুয়ারে রেশন প্রকল্প চালু রাখার জন্য রেশন দোকানের মালিকদের বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিল রাজ্য। প্রতি কেজি খাদ্য শস্য ও চিনির জন্য ৭৫ পয়সা করে ইনসেনটিভ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি যদি কোনও রেশন দোকান নিজস্ব তিন চাকা বা চার চাকার গাড়ি কিনতে চায়, সেক্ষেত্রে ২০ শতাংশ ভর্তুকি (সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত) দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। বর্তমানের ডিলারশিপের উপর অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে রেশন দোকানদারদের দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছিল।

দুয়ারে রেশনে অবস্থান স্পষ্ট মমতার

দুয়ারে রেশন প্রকল্প যাতে কোনওভাবেই বন্ধ না হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করতে তৎপর রাজ্য। সম্প্রতি বিধানসভাতেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছিলেন। বলেছিলেন, মানুষ দুয়ারে রেশন প্রকল্প চায়। কারও গায়ের জোরের কাছে সরকার যে মাথা নোয়াবে না, সেই অবস্থানও স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জোর গলায় বলেছিলেন, “দুয়ারে রেশন করবই।”

খাদ্য সুরক্ষা আইন, ২০১৩-র কোথায় সংঘাত?

মামলাকারীদের পক্ষের আইনজীবী দেবাশিস সাহা টিভি নাইন বাংলাকে জানিয়েছেন, নতুন জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন ২০১৩ সালে নিয়ে আসে কেন্দ্রীয় সরকার। সেখানে, রেশন দোকানদাররা লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেশন দেবে, এমন কোনও কথা উল্লেখ নেই। রেশন সামগ্রী দোকান থেকে সংগ্রহ করাটাই হল গ্রাহকদের দায়িত্ব। কিন্তু রাজ্য সরকার যে প্রকল্প চালু করেছে, তা অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেশন সামগ্রী দিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের কোনও সংশোধন হয়নি। ফলে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া যায় না।

যদিও এর পাল্টা যুক্তি রয়েছে রাজ্যেরও। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, “জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের ১২ ও ৩২ ধারায় প্রগেসিভ রিফর্মস করার সুযোগ আছে। আর আমরা তো অতিরিক্ত পয়সা দিয়েছি। হ্যান্ডেলিং লসের টাকা দিয়েছি। এদের অসুবিধা, এরা বলত… আমরা দোকানদার, আমরা কেন বেরোব। কিন্তু বুঝতে হবে, সরকার ফর দা পিপল, বাই দা পিপল, অফ দা পিপল।”

কলকাতা হাইকোর্টে দুয়ারে রেশন

প্রথম দফায় যখন রেশন ডিলারদের সংগঠন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিল, তখন তা খারিজ হয়ে গিয়েছিল। পরে ফের তাঁরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এবার ডিভিশন বেঞ্চে। হাইকোর্টের বিচারপতি চিত্তরঞ্জন দাশ এবং বিচারপতি অনিরুদ্ধ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানি চলে। শেষে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছিল, দুয়ারে রেশন প্রকল্পের আইনি বৈধতা নেই। আইনে এই প্রকল্পের কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই বলে জানিয়েছিল হাইকোর্ট। প্রকল্প বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত।

সুপ্রিম কোর্টে দুয়ারে রেশন

কলকাতা হাইকোর্টের রায় বিপক্ষে যাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্য সরকার। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি এমএম সুন্দ্রেশের বেঞ্চ হাইকোর্টের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। এই বিষয়ে রাজ্যের আইনজীবী সঞ্জয় বসু জানিয়েছিলেন, “পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এই প্রকল্প চালু রাখার ক্ষেত্রে কোনও আইনি বাধা থাকল না।”

রাজ্যের তরফে সুপ্রিম কোর্টে জানানো হয়েছিল, এই প্রকল্প জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন, ২০১৩-র পরিপন্থী নয়, বরং এর সহযোগী। রাজ্যের আইনজীবী আদালতে জানান, এই আইনের আওতায় রাজ্যকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, খাদ্যের সঙ্গ জড়িত কোনও জনহিতকর প্রকল্প চালু করার।