কলকাতা : মরিচঝাঁপি (Marichjhapi)। বাংলার রাজনীতিতে যতবার এই প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে, ততবার তা বামেদের (Left Front) অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। সুন্দরবনের এই ছোট্ট দ্বীপ অঞ্চলটিকেই এখন নতুন করে আন্দোলনের হাতিয়ার করছে বঙ্গ বিজেপি শিবির। ৩১ জানুয়ারি ‘মরিচঝাঁপি চলো’ কর্মসূচি পালন করছে বিজেপির তফশিলি মোর্চা (BJP SC Cell)। উদ্বাস্তু প্রসঙ্গে বিজেপির মনোভাবকে আরও সুচারুভাবে আমজনতার কাছে তুলে ধরার জন্যই বিজেপির এই কর্মসূচি। সেই সঙ্গে মরিচঝাঁপির ভয়ঙ্কর ইতিহাসের কথাও বাংলার মানুষের স্মৃতিতে আরও একটা ভাসিয়ে তোলার চেষ্টায় বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব। ঠিক কী ঘটেছিল মরিচঝাঁপিতে? কেন বারবার বামেদের অস্বস্তিতে পড়তে হয় মরিচঝাঁপির প্রসঙ্গ উঠলেই? আর বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিজেপির এই মরিচঝাঁপি চলো কর্মসূচিই বা কীসের জন্য?
ঘটনার সূত্রপাত এখন থেকে চার দশকেরও বেশি আগে। ১৯৭৯ সাল। দিনটা ছিল জানুয়ারির ২৮ থেকে ৩১ তারিখ। অর্থাৎ আজ প্রায় ৪৩ বছর আগের কথা। এক ভয়ঙ্কর হত্যালীলার সাক্ষী থেকেছিল সুন্দরবনের এই দ্বীপটি। অভিযোগ, পুলিশি হত্যালীলা চলেছিল। রক্তে লাল হয়েছিল মরিচঝাঁপির মাটি। সঠিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান আজও স্পষ্ট নয়। সরকারি একটি হিসেব রয়েছে বটে। তৎকালীন বাম সরকারের হিসেব অনুযায়ী দুই জনের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু এমনও একাধিক তথ্য পাওয়া গিয়েছে, যেখানে ওই অত্যাচারের শিকার হওয়া মানুষরা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী – মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
অতীতের একাধিক নথি বলছে, ওপার বাংলায় দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হলে, অনেক শরনার্থীই প্রাণ ভয়ে এপার বাংলায় চলে আসেন। তখন বাংলায় কংগ্রেস সরকার। কিন্তু সেই সময় তাঁদের বাংলায় থাকতে দেওয়া হয়নি। পরিবর্তে দণ্ডকারণ্য (ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশ) এলাকায় তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অথচ, দণ্ডকারণ্যের পাথুড়ে, জঙ্গলে ঘেরা জমির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলেন শরণার্থীরা। তার উপর ভাষাগত ব্যবধান তো ছিলই। পরিস্থিতি ক্রমেই প্রতিকূল হয়ে আসছিল। সেই সময় বামেরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল – তারা ক্ষমতায় এলে দণ্ডকারণ্য থেকে শরণার্থীদের রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। সেখানকার উদ্বাস্তু শিবিরগুলি পরিদর্শনও করেছিলেন বাম নেতারা। ক্রমেই ওপার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু শিবিরের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বামেরা। বিশেষ করে জ্যোতি বসুর নিজেরও এককালে শিকড় ছিল পূর্ববঙ্গে। তাই উদ্বাস্তুদের প্রত্যাশাও ছিল অনেকটা।
এদিকে বাম সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বার কয়েক প্রতিশ্রুতি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হলেও, কাজের কাজ কিছু হয়নি। বাম বিরোধীদের অনেকেই বলে থাকেন, বামেরা সরকারের এসে উদ্বাস্তুদের দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়েছিল। এরই মধ্যে দণ্ডকারণ্যের পুনর্বাসন শিবির থেকে উদ্বাস্তুদের একাংশ চলে আসেন সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি দ্বীপে। ওদিকে দণ্ডকারণ্যের পাথুড়ে জমিতে প্রতিকূলতা এতটাই বেশি হয়ে উঠেছিল, যে সুন্দরবনের বাঘের সঙ্গে সহাবস্থানও তুলনামূলকভাবে ভাল বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। এদিকে বাম সরকার উদ্বাস্তুদের বাংলায় পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়ে আসলেও, পরে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বলে অভিযোগ। তাই খবর পাওয়া মাত্র, মরিচঝাঁপি থেকে উদ্বাস্তুদের সরাতে অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে তৎকালীন বাম সরকার। তাদের সেখান থেকে হঠাতে পুলিশ পাঠানো হয় মরিচঝাঁপিতে। রুখে দাঁড়ান শরনার্থীরাও। সংঘর্ষ বাধে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি চালায় পুলিশ। অভিযোগ, পুলিশের সেই এলোপাথাড়ি গুলিতে বহু উদ্বাস্তু প্রাণ হারিয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে বামফ্রন্ট সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী কিরণময় নন্দের মুখে শোনা গিয়েছিল, “ক্ষমতায় আসার আগে অনেক কথা বলার দরকার হয়। কিন্তু ক্ষমতায় বসে সব কথা পালন করা সম্ভব নয়।” সেদিনের ঘটনাকে যাঁরা সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন, যাঁরা কোনওরকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই অভিযোগ তুলে থাকেন, সেই হত্যালীলার পর নাকি পুলিশকর্মীরা এবং স্থানীয় সিপিএম ক্যাডারটা মিলে দেহ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। এরপর বাকি থাকা পরিবারগুলির উপরেও ওই বছরের মে মাসে আক্রমণ হয় বলে অভিযোগ। আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তাতে প্রায় ৩০০ টি পরিবার রাতারাতি ঘরছাড়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। যদিও এই ধরনের দাবির কোনও প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তৎকালীন সরকার অবশ্য গুলি চালানোর কথা স্বীকার করেছিল। তবে, সরকারি হিসেবে মৃত্যু হয়েছিল দুই জনের।
এবার সেই ঘটনার প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় পর বিজেপি ফের একবার এই মরিচঝাঁপি ইস্যুটিকে হাতিয়ার করছে। একদিকে যখন বিজেপির মতুয়া মুখ শান্তনু ঠাকুর ‘বিদ্রোহী’ হয়ে উঠেছেন, ঠিক সেই সময় এই মরিচঝাঁপি চলো কর্মসূচি যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। মরিচঝাঁপি নিয়ে তদন্তের দাবি তুলছেন তাঁরা। বিশেষ করে সামনেই যখন পুরভোট রয়েছে, তখন ‘উদ্বাস্তু’ ভোটারদের কাছে টানতে বিজেপির এই কর্মসূচি বেশ কৌশলী চাল বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ, বিগত নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়লেও উদ্বাস্তু ভোটারদের একটি বড় অংশকে নিজেদের কাছে টানতে পেরেছিলেন।
আরও পড়ুন : স্কুল খোলা নিয়ে শুভেন্দুর সঙ্গে আলোচনা করতে নারাজ রাজ্য! চিঠি উচ্চশিক্ষা দফতরের