কমলেশ চৌধুরী : ধন্যি মে! আয়লা, আমপান, ইয়াস আছড়ে পড়ার মাসে আরও একটি ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা। তবে একটিতেই ক্ষান্ত নয় প্রকৃতি। আশঙ্কা একজোড়া ঘূর্ণিঝড়ের। একেবারে একইসঙ্গে। আবহবিদদের ভাষায়, টুইন সাইক্লোন বা যমজ ঘূর্ণিঝড়!
না। সেই আশঙ্কা নেই। তবে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ পূর্বসূরি আমপানের মতোই বাহুবলী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে কি না, তার অনেকটা নির্ভর করবে অন্যটির উপর।
অন্যটি অর্থাত্, যমজ ঘূর্ণিঝড়ের দ্বিতীয় অবতার জন্ম নিতে চলেছে ভারত মহাসাগরে। মোদ্দা কথা, দুই গোলার্ধে দুই ঘূর্ণিঝড়। নিরক্ষরেখার উত্তরে অশনি। আর নিরক্ষরেখার দক্ষিণে দ্বিতীয়টি। ইতিমধ্যেই আন্দামান সাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। রবিবারের মধ্যে তিন দফায় শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। ভারত মহাসাগরের নিম্নচাপও দ্রুত ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পথে। ইঙ্গিত তেমনই।
পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘এর নেপথ্যে ওয়েস্টার্লি উইন্ড বার্স্ট বা পশ্চিমী বাতাসের বিস্ফোরণ। এই মুহূর্তে ভারত মহাসাগরের পশ্চিমী বাতাসের প্রবাহ এতটাই জোরদার যে দুই গোলার্ধে একই সঙ্গে দুই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পার্থক্য বলতে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের বায়ুপ্রবাহ ঘুরবে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে। ভারত মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড়ের বায়ুপ্রবাহ হবে ঘড়ির কাঁটার পথেই।’
অনেকটা দাঁড়িপাল্লার মতোই দুই প্রান্তে দুই ঘূর্ণিঝড়। পার্থসারথির কথায়, ‘বায়ুপ্রবাহের একটি অংশ টানছে আন্দামান সাগরে থাকা নিম্নচাপ। অন্য অংশ টানছে ভারত মহাসাগরের নিম্নচাপ। যে বেশি পশ্চিমী বাতাস টানতে পারবে, সেই নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় তত বেশি শক্তিশালী হবে।’
হাতের কাছেই উদাহরণ। ২০১৯ সালের ৩ মে যখন ঘূর্ণিঝড় ফণী পুরীতে আছড়ে পড়ে, একই সময়ে ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় লর্না। সে বার লর্না সে ভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি। তাই চরম তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় ফণী। মাসুল গুনতে হয়েছিল পুরী-সহ ওড়িশার বিস্তীর্ণ তল্লাটকে। এ বার এখনও পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, ফণী বা আমপানের মতো শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা কম অশনির। ১০ মে নাগাদ বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠতে পারে ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটারে। সেখানে বঙ্গোপসাগরে সুপার সাইক্লোনে পরিণত হওয়া আমপান যখন বকখালি হয়ে স্থলভাগে ঢোকে, তখন বাতাসের সর্বোচ্চ বেগ উঠেছিল ১৮৫ কিলোমিটার/ঘণ্টায়।
ঠিক এখানেই ভারত মহাসাগরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমী বায়ুপ্রবাহের বড় অংশ টেনে নিচ্ছে ভারত মহাসাগরের সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ই। তবে তাতে কোনও জনপদের বিপদে পড়ার ভয় নেই। কারণ, ওই অঞ্চলে আশপাশে স্থলভাগ তেমন নেই। প্রাথমিক অবস্থান ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে অন্তত ১৫০০ কিলোমিটার দূরে।
তাহলে কি অশনি মামুলি ঘূর্ণিঝড় হিসেবেই থেকে যাবে? নাকি জলীয় বাষ্পের জোগানে ঘাটতি থাকায় জাওয়াদের মতো সাগরেই দুর্বল হয়ে পড়বে? মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি বাড়ানোর বিষয়টি অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সমুদ্রের জলতলের পর্যাপ্ত তাপমাত্রা অন্যতম শর্ত। সেই শর্ত অনুকূল রয়েছে। আবার শুধু ভারত মহাসাগর নয়, আরব সাগর, এমনকী দক্ষিণ চিন সাগর থেকে জলীয় বাষ্পের জোগান পাবে আন্দামান সাগরের নিম্নচাপ। তাই আরও কিছুটা সময় না গেলে স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।’
ঘূর্ণিঝড় কোথায় আছড়ে পড়বে, তা-ও এখনও স্পষ্ট নয়। মৌসম ভবন জানিয়েছে, ১০ মে অন্ধ্রপ্রদেশ-ওড়িশা উপকূলের কাছে পৌঁছবে অশনি। কিন্তু ল্যান্ডফল কোথায় করবে, তা জানায়নি। মৌসম ভবনের অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট, অন্ধ্র-ওড়িশা উপকূলের কাছ থেকে উত্তর-পূর্ব বাঁক নিতে পারে অশনি। তাহলে বাংলাদেশের দিকে এগোনোর সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। যদি তা হয়, সেক্ষেত্রে সরাসরি বাংলাদেশে যাবে, না ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মতো সুন্দরবন ছুঁয়ে বাংলাদেশে যাবে, সমস্ত সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখছেন আবহবিদরা। গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টির পর ছবিটা আরও স্পষ্ট হতে পারে।