তৃণমূল জমানায় যতবার নির্বাচন এসেছে, ততবারই সবথেকে বেশি আলোচিত হয়েছে যাঁর নাম, তিনি মীরা পাণ্ডে (Mira Pandey)। বিরোধীরা এই মীরা-তিরেই বারবার শাসকের ‘মেরুদণ্ড’কে নিশানা করেছে। পুরভোটের পর পঞ্চায়েত ভোটেও সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। বরং এবারের পঞ্চায়েত ভোটে তিনি আরও বেশি করে আলোচনায় উঠে আসছেন। মীরা পাণ্ডে সেই ব্যক্তিত্ব, যিনি ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে করতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। আর্জি ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর। আধাসেনা মোতায়েনের জন্য রাজ্যপালের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন। যা ঘিরে বিতর্ক সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশে অতি স্পর্শকাতর এলাকায় সেবার আধাসেনা মোতায়েন করেই ভোট করিয়েছিলেন তিনি। যা নিয়ে তৎকালীন এই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে তৃণমূল সরকারের বিরাগভাজনও হতে হয়। তবে পিছু হঠেননি তিনি। এবারও রাজ্যজুড়ে অশান্তির ছায়া। হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, ভোট হবে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই। কিন্তু এখনকার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা (Rajiva Sinha) বাহিনী দিয়ে ভোট করাতে চান না। রাজ্যজুড়ে বাহিনী দিয়ে ভোটের দরকার আছে বলে মনে করেন না তিনি। রাজ্যও কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোটের বিপক্ষে গিয়েছে আদালতে। সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে তারা। মঙ্গলবার সেই মামলার শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের শীর্ষ আদালত কী রায় দেবে তা তো সময়ই বলবে। তবে বিরোধীরা বলছে, এক নির্বাচন কমিশনার যিনি মানুষের স্বার্থে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে সুপ্রিম কোর্ট অবধি ছুটেছিলেন। আদায় করে এনেছিলেন মানুষের নিরাপত্তা। আরেকজন নির্বাচন কমিশনার ছুটেছেন আদালতে। আর্জি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় ভোট যেন না হয়।
বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, “তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১০ বছরে সমস্ত প্রশাসনের রাজনীতিকরণ করে ফেলেছে। এটা ওরা ওদের সাফল্য হিসাবে দেখে। কিন্তু এটাই যে ভবিষ্যতে ওদের সর্বনাশ ডাকবে আঁচ করতে পারেনি এখনও। দৃঢ়তা দেখাতে পারবে না এমন ব্যক্তিই তো বেছে নেওয়া হয়েছে এবার। এটাই তো স্বাভাবিক।”
সিপিএম-কংগ্রেস বলছে, শিরদাঁড়া সোজা থাকলে তিনি কখনওই এই সরকারের রাজ্যে নির্বাচন কমিশনার হওয়ার সুযোগ পেতেন না। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “সকলের তো মেরুদণ্ড থাকে না। মীরা পাণ্ডেকে সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মনে রাখবে। কারণ তিনি মেরুদণ্ড সোজা করে বলতে পেরেছিলেন মানুষের নিরাপত্তা আগে। শাসকদলের কথায় মাথা নীচু করে থাকেননি।”
অন্যদিকে কংগ্রেসের মুখপাত্র ঋজু ঘোষালের কথায়, “আসলে এটা শিরদাঁড়ার ব্যাপার। কেউ নিজের শিরদাঁড়া বিক্রি করেননি, কেউ আবার তা বিক্রি করেও ক্ষান্ত হননি। হামানদিস্তা দিয়ে গুঁড়ো করে পেস্ট বানিয়ে লেপে দিয়েছেন শাসকদলের পায়ে। তাই যা হওয়ার হচ্ছে।”
২০১৩ সালে শুধু আধাসেনা মোতায়েন করেই ভোট হয়নি। রাজ্য সরকারের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আদালতে গিয়ে পাঁচ দফায় ভোট করান তিনি। সে বছর এক দফায় ভোট করাতে চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে এক দফায় সম্ভব নয় জানিয়েছিল কমিশন। পরবর্তীতে দু’দফায় ভোটের প্রস্তাব দেয় সরকার। কিন্তু তাও মানেননি মীরা। এবার ৭ তারিখে দায়িত্বে বসে পরের দিনই ভোটের দিন ঘোষণা করেন রাজীব সিনহা। মনোনয়ন পর্বে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অশান্তি বাধে। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোটের দাবি ওঠে। মামলা হয় হাইকোর্টে।
আদালত কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। কমিশন আদালতের নির্দেশ মানবে বলে প্রথমে জানান রাজীব সিনহা। একদিন কাটতে না কাটতেই রাজ্য নির্বাচন কমিশন জানায়, কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে তারা। কমিশনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। বিরোধীরা কমিশনের বিরুদ্ধে সরব হয়। আর এরই প্রেক্ষিতে উঠে আসে মীরা পাণ্ডের কথা। আবার ২০১৩ সালের মতো ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হবে কি না, তা আদালতেই ঠিক হবে।