কলকাতা: মাকড়সার জাল। মাঝখানে গডফাদার। চারদিকে ছড়িয়ে নেটওয়ার্ক। যে কোনও সংগঠিত অপরাধের ক্ষেত্রেই এই থিওরিতে তদন্ত চালান গোয়েন্দারা। বাংলার শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির (Recruitment Scam) ক্ষেত্রেও এই প্যাটার্ন হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। কিন্তু এই দুর্নীতির বহর যেন যেকোনও থ্রিলার সিনেমাকে ১০ গোল দিতে পারে। এক্কেবারে ‘কর্পোরেট কায়দায়’ দুর্নীতি। অপরাধের দুনিয়ায় ‘স্নিপার সেল’ বলে একটা কথার চল আছে। স্লিপার সেলের লোকজন জানে না এদের বিগবস কে। তবু একজনের নির্দেশে এরা কাজ চালিয়ে যায়। নিয়োগ দুর্নীতিতেও এরকম ‘স্নিপার সেল বা কাট আউটরা’ ছিলেন। যাঁরা জানতেন না তাঁদের টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে জমা হচ্ছে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল কর্মসিদ্ধি। তাই পরের ‘দাদা’কে টাকা দিয়েই তাঁদের দায় সারা হত। প্রাক্তন সিবিআই অধিকর্তা উপেন বিশ্বাসের মতে, এঁরা ‘কাট আউট।’
জেলায় জেলায় ছড়িয়ে এজেন্টরা। গ্রাউন্ড এজেন্ট থেকে একদম এসএসসি, স্ট্রং কানেকশন। যা হার মানাতে পারে কোনও বিদেশের অফিসের কর্পোরেট কালচারকেও। তদন্তে নেমে নেটওয়ার্ক দেখেই তাজ্জব কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
গ্রামের দিকে পুকুরে মাছ ধরার কায়দা হল, আগে কোথায় বেশি মাছ আছে সেই জায়গা চিহ্নিত করা। তারপর তাল বুঝে সেখানেই ফেলতে হয় জাল। আর কিছুক্ষণ পর আসতে আসতে জাল টানলেই উঠে আসে কেজি কেজি রুই, কাতলা। নিয়োগ দুর্নীতিতে পুকুরের সেই মাছময় জায়গাটা ছিল ডিএলএড ও বিএড কলেজ। সেখানে জাল ফেলেই শিকার ধরতেন গ্রাউন্ড এজেন্টরা। চাকরিপ্রার্থীরা টোপ গিললে, তাঁদের টাকা ও নথি চলে যেত মিডলম্যানদের কাছে। সেই মিডলম্যান মারফত কেস পৌঁছত বড় এজেন্টের হতে। সেই বড় এজেন্ট আসলে প্রভাবশালীর মদতপুষ্ট। আর প্রভাবশালী হলেন সর্বেসর্বা। তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই রাত হয়ে যেতে পারে দিন। তিনি চাইলেই কোনও পরীক্ষায় না বসলে পাশ হওয়া যায়। এই প্রভাবশালীর আশীর্বাদেই তৈরি হত চাকরিপ্রাপকদের তালিকা। তারপর হাইপাওয়ারড কমিটির নির্দেশে সুপারিশপত্র তৈরি করত এসএসসি। আর তার ভিত্তিতেই নিয়োগপত্র দিত মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। প্রাথমিকে চাকরির ক্ষেত্রে প্রভাবশালীর নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ বাকি কাজটা সেরে ফেলত।
নিয়োগ দুর্নীতিতে এখনও পর্যন্ত একাধিক ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। তবে প্রাক্তন সিবিআই অধিকর্তা উপেন বিশ্বাসের মতে, এখনও গডফাদার অধরা। তিনিই এই দুর্নীতির মাকড়সা। যাঁর জাল সবদিকে ছড়িয়ে। এখনও পর্যন্ত যাঁদের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা হাতে পেয়েছে, তাঁদের কত ক্ষমতা?
গ্রাউন্ড এজেন্ট: শাহিদ ইমাম, আব্দুল খালেক, ইমাম আলি, কৌশিক ঘোষ, সুব্রত সামন্ত রায়।
মিডলম্যান: প্রদীপ সিং, প্রসন্ন রায়, চন্দন মণ্ডল
বড় এজেন্ট: কুন্তল ঘোষ
প্রভাবশালী: মানিক ভট্টাচার্য, পার্থ চট্টোপাধ্যায়
উপদেষ্টা কমিটি: শান্তিপ্রসাদ সিনহা
এসএসসি: সুবীরেশ ভট্টাচার্য, অশোক সরকার
পর্ষদ: কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক ভট্টাচার্য
রঞ্জন অতি সৎ ছেলে। তিনি চাকরি বিক্রি করেন। তাঁর বাড়িতে টাকা দিতে আসার লাইন পড়ে। তবে কেউ চাকরি না পেলে সুদ সমেত টাকা ফেরত দেন। উপেন বিশ্বাস এই সৎ রঞ্জনের স্রষ্টা। তবে আসলে এই সৎ রঞ্জন হলেন চন্দন মণ্ডল। শুধু মিডলম্যান ভাবলে ভুল হবে। তাই এই প্রতিবেদনেও একটু অতিরিক্ত জায়গা প্রাপ্য সৎ রঞ্জনের। দুঁদে গোয়েন্দাদের মতে, অনেক সময় গ্রাউন্ড এজেন্টরা গডফাদারের খুব কাছের হয়ে যেতেন। চন্দনও সেইরকম একজন। মন্ত্রী পর্যায়ে তাঁর যোগাযোগ ছিল ইনস্ট্যান্ট নুডলসের মতো। যখন ইচ্ছে তখন তৈরি। তবে এই ইনস্ট্যান্ট কানেকশন বানাতে বেশ কয়েক বার কলকাতায় জিপগাড়ি বোঝাই করে টাকা আর মাছ পাঠাতে হয়েছে বলেও অভিযোগ।
চাকরি চুরিতে অভিযুক্ত মিডলম্যান বা এজেন্টদের হরেকরকম কিসসা সামনে এসেছে। কেউ নায়ক, কেউ সমাজসেবী, কেউ আবার পোক্ত প্রযোজক। এদের এই এত কর্মকাণ্ড আসলে মাকড়সার জালেরই অংশ, মনে করেন গোয়েন্দারা। কারণ চাকরি চুরির কালো টাকা সাদা করতেই জাল ছড়িয়েছে চারদিকে। বেশিরভাগ লেনদেন নগদেই। তাই টাকার কূল আদৌ পাওয়া যাবে কি? এই প্রশ্নের উত্তরে একটা বড় বিস্ময়সূচক চিহ্ন ছাড়া আপাতত আর কোনও শব্দ বা জ্যোতিচিহ্ন ব্যবহার করা যাচ্ছে না।