Swarnendu Das: নিউজ রুম ছেড়ে চিরতরে চলে গেল স্বর্ণেন্দু, ঝাপসা চোখে প্রিয় ‘স্বর্ণ’র স্মৃতি তর্পণে সহকর্মীরা…

TV9 Bangla Digital | Edited By: সায়নী জোয়ারদার

Aug 23, 2022 | 3:04 PM

Swarnendu Das: মঙ্গলবার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন স্বর্ণেন্দু দাস। দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি।

Swarnendu Das: নিউজ রুম ছেড়ে চিরতরে চলে গেল স্বর্ণেন্দু, ঝাপসা চোখে প্রিয় স্বর্ণর স্মৃতি তর্পণে সহকর্মীরা...
নিউজ রুম ছেড়ে চিরতরে চলে গেল স্বর্ণেন্দু দাস।

Follow Us

মঙ্গলবার সকালে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নিউজ রুমে সকালের শিফটের লোকজন সবে কাজে গতি তুলেছে। হঠাৎই নিউজ রুমে খবর এল, স্বর্ণেন্দু আর নেই। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে গেল বাকিদের কাছেও। স্বর্ণেন্দুর শরীরটা বেশ কিছুদিন ধরেই খারাপ। বিরল ক্যান্সার ওর। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের ডাক্তাররাও জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন। তবু বুকের ভিতর কোনও একটা নিভু নিভু আঁচ জ্বলছিল। কে জানে কত মিরাক্যালই তো হয়। আমরাই তো সেসব খবর করি। কিন্তু হল না স্বর্ণেন্দু, তোমার বেলায় কোনও ম্যাজিক হল না। নিউজ রুম ছেড়ে চিরতরে চলে গেলে। সহকর্মীদের দিয়ে গেলে এক বুক স্মৃতি…

সোমা দাস

২০১০ সালে আমি তখন অন্য একটা চ্যানেলে। একটা অল্প বয়সী ছেলে এল ট্রেনি রিপোর্টার হয়ে। যে কোনও কিছুতেই ওর খুব জানার ইচ্ছে। কিছু হলেই বলত শিখিয়ে দাও, বলে দাও। তারপর এতদিন পর আবার আমরা টিভি নাইন বাংলায় এলাম। আমার সহকর্মী। এতদিন পরও ওর শেখার ইচ্ছে কিন্তু একটুকু যায়নি। অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারত। সুব্রত মুখোপাধ্যায় যেদিন মারা গেলেন, ওরও অ্যাসাইনমেন্ট। বারবার বলছে, তুমি বলে দেবে কী করতে হবে, কোথায় থাকব। আরেকটা অদ্ভুত জিনিস আমরা দেখলাম, একটা ছেলেকে ডাক্তার বলে দিয়েছে ক্যান্সার, ক্রমেই খারাপ হচ্ছে অবস্থা। তারপরও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ব্রেকিং দিচ্ছে, ফোনো দিচ্ছে। রেলের খবর, বিএসএফের খবর ব্রেক করছে। আসলে খবরের মধ্যে থাকলেই ও ভাল থাকত। আমরাও সেটা জানতাম। যখন ওর পটাশিয়াম, সোডিয়াম নামছে, হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছেলেটা বলছে, ‘এটা পিসিআর, এখানে এত কথা কেন’? অথচ কেউ কিন্তু চিৎকার করছে না। ওর মনে হচ্ছে চিৎকার হচ্ছে। কখনও বলছে, ‘আমার ফোনোটা নাও’। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আওড়ে গেছে এসব কথাগুলো। গেলেই বলত, বেঁচে যাব বল দিদি? বলতাম, ঠিক হয়ে যাবি। কিন্তু আমি জানি ক্যান্সার কী। আমার মাকে হারিয়েছি এই ক্যান্সারেই। ডাক্তাররা আমাকেও সময় বেধে দিয়েছিল। ওরও তো তাই হল।

সায়ন্ত ভট্টাচার্য

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করতে করতে যে কোনও খবর ধরানো স্বর্ণেন্দু আমার কাছে সাংবাদিক নয়, এক লড়াকু যোদ্ধা। আমি প্রিন্ট মিডিয়া থেকে এসেছি। তাই এর আগে স্বর্ণেন্দুর সঙ্গে কখনওই একসঙ্গে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে কাজ করা হয়নি। এখানে এসেই প্রথম কাজ করা শুরু হয়। টিভি নাইন বাংলার শুরুর সময় সম্পাদকমশাই একদিন বললেন স্বর্ণেন্দু বলে এক ভালো রিপোর্টার রয়েছে। আমাদের এখানে সিভি দিয়েছে। আমরা কি নিতে পারি? আমি শুনেছিলাম স্বর্ণেন্দু খুব ভাল পরিবহণ বিট করে। মেট্রো, রেল, একইসঙ্গে সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর খবর করে। আমি সবার মাঝে বলে উঠেছিলাম একদমই। খুব ভালো রিপোর্টার। সেই শুরু স্বর্ণেন্দুর সঙ্গে কাজ করা। বঙ্গে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল, দিঘায় গিয়ে অসম্ভব ভাল খবর করেছিল। শুধু মাঝে মধ্যে বলত, শরীরে যদি কোন রোগ না থাকত তাহলে আমি আরও বড় হতে পারতাম। স্বর্ণেন্দু এবং আমার দুজনেরই বেলা এগারোটা অথবা বারোটার শিফট থাকত। তাই কাজ শেষ করে আমরা প্রেস ক্লাবে বসে গল্প করতাম। কিন্তু সেখানে বসেও ওকে তাড়িয়ে বেড়াত খবরের খিদে। একদিন প্রেস ক্লাবে আমায় বলল, করোনার জন্য কাজে সেরকম গতি পাচ্ছি না। কোনও ছোটাছুটি নেই, দৌড়াদৌড়ি নেই। সেই আক্ষেপ কাটিয়ে কিছুটা ছোটাছুটি শুরু করেছিল। কিন্তু তা যে ক্ষণিক কালের জন্য তা বোঝা যায়নি। যেদিন খবর পেলাম রাস্তায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে গিয়েছে ও, সেদিনও জানতাম না এটাই হয়তো ওর শেষবার রাস্তায় নামা। যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস আমার সাংবাদিক যোদ্ধা।

কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায়

স্বর্ণদার জন্য এ ভাবে কলম ধরতে হবে, ভাবিনি। ২৩ অগস্ট দিনটা আবার আমার কাছে আতঙ্কের হয়ে থাকল। সেই কোন ছোটবেলায় পাড়ার এক কাকুকে (বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু) এই দিনে চলে যেতে দেখেছিলাম। সেও ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে এই দিনে হেরে গিয়েছিল। আবারও সেই ২৩ অগস্ট। আবারও সেই ক্যান্সার কেড়ে নিল কাছের মানুষকে। ২০১৫ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় আমরা একই নিউজ চ্যানেলে কাজ করি। কলকাতার মিডিয়া হাউজে এটাই ওটাই ছিল আমার প্রথম কর্মক্ষেত্র। সেখানেই আলাপ স্বর্ণদার সঙ্গে। মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত। আমি ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত স্বর্ণদার সঙ্গে কাজ করেছিলাম। মাঝের দু’বছর বাদ দিয়ে আবার এখানে দেখা। কত স্মৃতি। ২০১৭ সালের ২২ মে। দিনটা কখনও ভুলব না। বামেদের নবান্ন অভিযান ঘিরে উত্তাল রাস্তাঘাট। অফিস পৌঁছতে কিছুটা দেরী হয়েছিল। ঢুকেই দেখি সবাই ছোটাছুটি করছে। অফিসের টিভিতে চোখ রাখতেই এক বীভৎস ছবি। সে দিন ঝামেলার রেশ এতটাই গড়াল, যে সাংবাদিকদেরও লাঠির ঘা খেতে হল। ক্যামেরা পার্সনকে বাঁচাতে গিয়ে মার খেতে হল স্বর্ণদাকে। ভিডিওটা এখনও চোখে ভাসে।

স্বর্ণদার কোনও বিট ছিল না। সব বিটে সমান পারদর্শী। কেরিয়ারের শুরুতে মাঠ করত। নিজের চোখে দেখেছি, যে কোনও জায়গাতেই স্বমহিমায় খবর করত স্বর্ণদা। টুইটার থেকে কীভাবে খবর খুঁজতে হয়, তা স্বর্ণদাই দেখিয়েছিল। টেলিভিশনের জন্য একেবারে পারফেক্ট মানুষ ছিল। এত সুন্দর লাইভ দিতে আমি খুব কম মানুষকেই দেখেছি। যে বার মাঝেরহাট ব্রিজ ভাঙল, ওখান থেকে অফিসের লাইভ ইউনিট কাজ করছিল না। মোবাইল থেকে একের পর এক ওয়াকথ্রু দিয়ে ভিডিও পাঠাতে দেখেছিলাম স্বর্ণদাকে। ফিল্ড রিপোর্টারদের তাৎক্ষণিক বুদ্ধিটা খুব জরুরি। কখন কীভাবে সেটাকে কাজে লাগাতে হয়, তা স্বর্ণদাকে দেখেই শেখা। আদ্যন্ত মোহনবাগানপ্রেমী। একই সঙ্গে আর্জেন্টিনার ভক্ত। রাশিয়া বিশ্বকাপের সময় মেসেজে আর্জেন্টিনা নিয়ে কত কথা হয়েছিল। বলত, মেসির হাতে বিশ্বকাপটা দেখতে চাই ভাই। আবার একটা ফুটবল বিশ্বকাপ আসছে সামনে। আর্জেন্টিনার খেলা শেষের পর তোমার মেসেজটা আর পাব না। কঠিন সময় ক্রমশ তোমাকে গ্রাস করছিল। বুঝতে পারছিলাম সময় কমছে। কাতার বিশ্বকাপটা তো দেখে যেতেই পারতে স্বর্ণদা।

রক্তিম ঘোষ

২০০৭ সালে যখন বৈদ্যুতিন এক সংবাদমাধ্যমে স্বর্ণেন্দু সাংবাদিক হিসাবে কেরিয়ার শুরু করে তখন ও ছিল আদ্যোপান্ত ক্রীড়া সাংবাদিক। কলকাতা ময়দানের ফুটবল হোক বা আইপিএল। ওই চ্যানেলের প্রতিনিধি মানেই স্বর্ণেন্দু দাস। এমনকী ক্রীড়া সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন শহরে সফরও করেছে ও। এরপর ক্রীড়া সাংবাদিক তকমা সরিয়ে স্বর্ণেন্দু নিজেকে ছড়িয়ে দিল অন্য বিটেও। রেল, আবহাওয়া এবং পরের দিকে নিয়মিত বিজেপির খবরে হাত পাকিয়েছিল স্বর্ণেন্দু। সাংবাদিকমহলে ওর বন্ধুরা ওকে মজা করে বলত ভূমিকম্প। কারণ, ভারতের যে কোনও প্রান্তে ভূমিকম্প হলেই প্রথম খবরটা ব্রেক করত স্বর্ণেন্দুই। সেই স্বর্ণেন্দু একটা বছর আমার সহকর্মী ছিল। খুব কম সময়, কিন্তু মনে থেকে গেল।

দীপেন্দু পাল

অ্যাসাইমেন্ট বা কোঅর্ডিনেশন ডেস্কের কাছে রিপোর্টার হচ্ছে একজন প্ল্যানারও। স্বর্ণেন্দু সেটাই ছিল। ও কমপ্লিট ম্যান। ও রিপোর্টিং করেছে, কোঅর্ডিনেশন ডেস্কে বসেছে, প্রোডিউসারও ছিল। কিছু ব্রিফ করলে সেটা নিয়ে এতটাই তলিয়ে ভাবত, সেটা ওর কাজেও দেখা যেত। খুব প্রোডাকশন ফ্রেন্ডলি। আমি যতটা স্টোরি ব্রিফ করব, ও ঠিক সেইমতোই ভিজুয়াল, ওয়াক থ্রু এনে দেবে। ওর পিটিসি কাটতে কারও কোনও পরিশ্রম করতে হত না। পয়েন্ট টু পয়েন্ট পিটিসি দিত। যে কোনও সময়, যে কোনও জায়গায় ওকে যেতে বলা হোক, কোনও না নেই। ডিফেন্স থেকে ট্রান্সপোর্ট, পলিটিক্যাল সব বিটে ও তুখড়। আমরা সত্যি স্বর্ণেন্দুকে মিস করব।

Next Article