কলকাতা: এক হড়পা বানেই সব শেষ। লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে সিকিম। বিধ্বস্ত উত্তরবঙ্গ। শেষ পাওয়া সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, এখনও পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৪। শুধু সিকিমেই আটকে রয়েছেন ৩০০০ পর্যটক। সিকিমে সিংটাম, মঙ্গন, টুং, জেমার মতো এলাকা মিলিয়ে ১৪ টি সেতু উড়ে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছে চুংথাম, ডেকচু জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ। সিংটাম, রংপো সোয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ধসে গিয়েছে। ১৯৬৮ সালের অক্টোবরেও একইভাবে তিস্তার রুদ্ররূপ দেখেছিল উত্তরবঙ্গবাসী। গত বছর অক্টোবরে মাল নদীতে হড়পা বানে গিয়েছিল একাধিক প্রাণ। কিন্তু কেন বারবার প্রকৃতির রুদ্ররোষে পড়ছে উত্তরবঙ্গ? এ বিষয়ে টিভি-৯ বাংলার সঙ্গে কথা বললেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজি বিভাগের গবেষক সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: বিগত কয়েক বছরে সিকিম-সহ উত্তরবঙ্গের একাধিক এলাকায় লাগাতার ভূমিধসের ঘটনা দেখতে পাওয়া গিয়েছে। কেন এমনটা হচ্ছে?
উত্তর: সিকিম কিন্তু টেকটনিক্যাল ভাবে খুবই অ্যাকটিভ জোনে পড়ে। সহজ কথায়, সিকিমের মাটির তলাটা খুব একটা শক্ত নয়, নড়ছে। নড়ছে কারণ হিমালয় এখনও তৈরি হচ্ছে। সিকিম-সহ গোটা হিমালয়ান রিজিয়নে অনেক চ্যুতি বা ফাটল আছে। এই ফল্টগুলি শিরা-উপশিরার মতো মাটির নীচে রয়েছে। নীচের মাটি অসমান অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বৃষ্টি হলে এই ফল্টগুলি দিয়েই প্রচুর জল ঢুকে যায়। মাটি আরও নরম হয়। যখনই জল ঢোকে তখন যদি মাটি খানিকটা কেঁপে যায় তখন ফল্ট বরাবার মাটি ধসে নীচে নেমে যায়। এটাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলে মাস ওয়েস্টিং। মূলত এই কারণেই ধসগুলি নামে।
প্রশ্ন: অনেক বলছেন গ্লেসিয়াল লেক আউটব্রাস্টের কথা। সেটা ঠিক কী জিনিস?
উত্তর: নদীর দুধারে যেমন বালি জমা পড়ে তেমনই গ্লেসিয়ার যখন যায় তখন তার দুধারে একধরনের জিনিস জমা পড়ে যার নাম মোরেন। এই মোরেনগুলি জমা হতে হতে স্তূপ হতে থাকে। ফলে গ্লেসিয়ার গলে যে জল তৈরি হয় সেটা এই মোরেনের মধ্যে আটকে থাকে। ফলে চাপ বাড়ে নদী বাঁধগুলিতে। এবার হঠাৎ একসঙ্গে অনেকটা গ্লেসিয়ার গলে গেলে বাঁধগুলিতে জলের ভারও অনেকটা বেড়ে যায়। এর ফলে মোরেনগুলি অনেক সময়ই ভেঙে যায়। ভেঙে যেতেই পুরো জলটা একধাক্কায় তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। এটাকে বলে গ্লেসিয়াস লেক আউব্রাস্ট। এরকমের ঘটনা রোজ কিন্তু হয় না। অনেকদিন অন্তর হয়। একটা বাঁধ ভাঙলে পরপর সব কটা বাঁধ ভাঙতে থাকে। ফলে একসঙ্গে অনেকটা জল বেরিয়ে গিয়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়।
প্রশ্ন: অতিবৃষ্টি কীভাবে ডেকে আনছে বিপদ?
উত্তর: সম্প্রতি যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা তো অতিবৃষ্টির ফলে হয়েছে। অতিবৃষ্টির ফলেও বাঁধে জলের চাপ বেড়ে যায়। সঙ্গে আবার যদি গ্লেসিয়ার ব্লাস্ট হয় তাহলে আর দেখতে হবে না। মুহূ্র্তে জলের তোড় সব সীমা ভেঙে যায়।
প্রশ্ন: এর পিছনে কী পার্বত্য এলাকায় পূর্ববর্তী ভূমিকম্পগুলির কোনও হাত রয়েছে?
উত্তর: এদিকে গত কয়েক মাসে এই সব এলাকাগুলিতে অতিবৃষ্টি হয়েছে। অতিবৃষ্টির কারণে ফল্টগুলিতে জল ঢুকেছে, তারপর আবার জল পড়ল। লাগাতার বর্ষণে মাটি নীচের ভারসাম্য অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। ফলে নানা প্রান্তে ধস দেখতে পাওয়া গেল। এদিকে মাটির তলার এই ফল্টগুলি কিন্তু যবে থেকে হিমালয় তৈরি হয়েছে তবে থেকেই আছে। কিন্তু, সম্প্রতি প্রাকৃতিক নানা কারণে ফল্টগুলির মধ্যে গতির সঞ্চার হচ্ছে। এর একটা কারণ অবশ্যই ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কারণে কিন্তু অনেক সময় নতুন নতুন ফল্ট তৈরি হতে পারে। আগেরগুলি জায়গা পরিবর্তনও করতে পারে। জল ঢুকলেও এগুলির স্থান আবার অনেক সময় বদলাতে পারে। টানা বর্ষার কারণে আবার এই ফল্টগুলির জল ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। একটু চাপ পড়লেই ধসে যাচ্ছে মাটি। সে কারণেই বারবার এই ধরনের বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে।