Loading video

আকাশে মিরাজের চক্কর আর মাটিতে বফর্স

TV9 Bangla Digital | Edited By: Tapasi Dutta

Jul 27, 2024 | 10:55 PM

ঠিক ২৫ বছর আগে ২৬ জুলাই কার্গিলের যুদ্ধ জয় করেছিল ভারত। শহিদ হয়েছিলেন ৫২৭ জন ভারতীয় জওয়ান। সেই বীর সেনানীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ কথা হবে দ্রাসের খুব কাছে মাটি থেকে প্রায় ১৬ হাজার ফুট উপরের এক পাহাড় চূড়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর এক রক্তক্ষয়ী লড়াই... কার্গিল যুদ্ধ...

ঠিক ২৫ বছর আগে ২৬ জুলাই কার্গিলের যুদ্ধ জয় করেছিল ভারত। শহিদ হয়েছিলেন ৫২৭ জন ভারতীয় জওয়ান। সেই বীর সেনানীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ কথা হবে দ্রাসের খুব কাছে মাটি থেকে প্রায় ১৬ হাজার ফুট উপরের এক পাহাড় চূড়ার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর এক রক্তক্ষয়ী লড়াই…

কার্গিল যুদ্ধ…

যেখানে সবচেয়ে বেশি গোলাগুলি ব্যবহার…১৯৭১-এর পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এটাই ছিল ভারতের প্রথম যুদ্ধ।
এবং আরও একবার পাকিস্তানের ল্যাজেগোবরে হওয়া। তারপরও শিক্ষা নেয়নি পাকিস্তান। বারবার হানা দেওয়ার চেষ্টা। কার্গিল বিজয় দিবসের ২৫ বছরে পাকিস্তানের উদ্দেশে হুঙ্কারের সঙ্গে তীব্র কটাক্ষও ছুড়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী…

শুক্রবার কার্গিলের দ্রাসে গিয়ে বীর শহিদদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তাঁদের পরিজনদের সঙ্গে কথা বলেন নরেন্দ্র মোদী। ওয়ার মিউজিয়াম পরিদর্শন করেন এবং জম্মু কাশ্মীরের শিনকুন লা টানেলের কাজের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ১৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই সুড়ঙ্গ হয়ে গেলে লেহর যোগাযোগ ব্যবস্থাই বদলে যাবে!

২৫ বছর আগের শীতেই এসেছিল বিপদ। বরফ পড়ার সুযোগে কার্গিল সেক্টরের উঁচু এলাকাগুলোতে ঘাঁটি গেড়ে বসে পাক সেনা। সেই হানাদার বাহিনীকে খেদাতে দুই মাসের যুদ্ধ। অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর জয় আসে। কার্গিল যুদ্ধে প্রথম থেকেই মারাত্মক প্রতিকূলতার মধ্যে ছিল ভারতীয় সেনা।

বিশ্বের অন্যতম দূর্গম যুদ্ধক্ষেত্রে খাড়াই বেয়ে উঠে তাঁদের লড়তে হচ্ছিল। পাক সেনা উপরে বসে ভারতীয় সেনার পুরো মুভমেন্টটাই দেখতে পাচ্ছিল। এই অবস্থায় যুদ্ধ জয়ের কথা ভাবাটাই কষ্টকল্পনা। সম্প্রতি পাক সরকারে হেফাজত থেকে যে গোপন নথি ফাঁস হয়েছে, তাতে স্পষ্ট…

 

প্রায় ২ বছর ধরে অপারেশন কার্গিলের প্ল্যানিং হয়। মাথা ছিলেন পারভেজ মুশারফ-সহ চার সেনাকর্তা। ১৯৯৮ সাল থেকেই কার্গিলে অনুপ্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল পাক সেনা। প্রায় ৫ হাজার জওয়ানকে কার্গিলে অনুপ্রবেশের জন্য পাঠিয়েছিলেন মুশারফ।

 

পাকিস্তানের কৌশলের পাল্টা হিসেব তিনটি ছকে এগোয় ভারত।

প্রথমত, বায়ুসেনার যুদ্ধবিমান মিরাজকে কাজে লাগিয়ে পাক ঘাঁটিগুলিতে আঘাত করা। দ্বিতীয়ত, বফর্স কামান থেকে লাগাতার গোলাবর্ষণ। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক মহলকে বলে দেওয়া পাক সেনা অনুপ্রবেশ করেছে।

তাদের উপড়ে বাইরে না ফেলা পর্যন্ত ভারত থামবে না। এরপরই কূটনীতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পাকিস্তান। আমেরিকা বা অন্য কোনও দেশ – নওয়াজ শরিফের পাশে দাঁড়াতে রাজি হয়নি।

উঁচুতে বসে থাকা পাক সেনা গুলিবৃষ্টি করছে! আর পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে তাঁদের তিনজনের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন গড়ে একজন ভারতীয় সেনা। তাঁদের একহাতে দড়ি, অন্য হাতে গুলি চালাচ্ছিলেন। পাহাড়ে চড়তে চড়তে কৌশল বদলেই সাফল্য পেতে শুরু করে ভারতীয় সেনা। কার্গিল অভিযানের শেষ ধাপে টাইগার হিল পুনর্দখলের কথা ছিল। যদিও তার আগে

পয়লা জুলাই রাতে রুট বদলে টাইগার হিলে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তেসরা জুলাই টাইগার হিলের দিকে ওঠা শুরু করে ভারতীয় সেনা। সেদিন রাত ছিল কার্গিল যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন ও বিপদসঙ্কুল। প্রাণহানি এড়ানো যায়নি। কমবেশি ৩৬ ঘণ্টার অভিযান। ৪ জুলাই সকালে টাইগার হিলের চূড়ায় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেয় ভারতীয় সেনা। ১৯৯৯ সালে কার্গিলে ঢোকা আড়াই হাজার পাক সেনার আর দেশে ফেরা হয়নি। ৭৫ শতাংশ দেহ ফেরতই নেয়নি পাকিস্তান। পিছিয়ে থেকে শুরু করেও পরাক্রম দেখিয়েছিল ভারতীয় সেনা। যে গাথা বলে শেষ করা যায় না।

কার্গিল যুদ্ধের ইতিহাস লেখা হয় বর্ফস কামানকে সঙ্গে করেই। যে বফর্স নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ঝড় উঠেছিল। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, সুইডেন থেকে কামান কিনতে ঘুষ নিয়েছেন রাজীব গান্ধী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা। যার ফল, ১৯৮৯ এ পড়ে যায় রাজীব গান্ধীর সরকার। বফর্স কামান নিম্নমানের বলেও অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। কার্গিল যুদ্ধে সত্যিটা আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। বফর্স ছাড়া কার্গিল জয় সম্ভবই ছিল না, একথা সকলেই এখন মানেন। তাই বফর্সের কথা না বললেই নয়।

 

দ্রাসের খুব কাছে মাটি থেকে প্রায় ১৬ হাজার ফুট উপরের এক পাহাড় চূড়া। মরণপণ যুদ্ধের পর জয়ের ঘোষণা করেছিল ভারতীয় সেনা। কীভাবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল ভারতের দিকে??? ওয়ার ভেটারান থেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তা, প্রায় সব্বার মুখে একটাই নাম বফর্স। কার্গিলের টাইগার হিলের পশ্চিমে কৌশলগতভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পাহাড় চূড়ার পুর্নদখল করে ফেলে ভারতীয় সেনা। ব্যাটল অফ পয়েন্ট ৪৮৭৫, কার্গিল যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন অপারেশনগুলির মধ্যে একটি। পয়েন্ট ৪৮৭৫-এ দাঁড়িয়ে ভারতীয় সেনার কম্যান্ডিং অফিসারের একটা উক্তি অমর হয়ে গিয়েছে।

কীভাবে বফর্স কামানের হাত ধরে যুদ্ধের মোড় ঘুরেছিল? কার্গিলে পাহাড়ের উপরে বসে ছিল পাক সেনারা। ইন্ডিয়ান আর্মি তো প্রথমেই পাহাড় বেয়ে উঠতে পারবে না। সেই চেষ্টা করলে উপর থেকে গুলিবৃষ্টিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। তাহলে উপায়? পথ ছিল একটাই। নীচে থেকে পাক পোস্টগুলোকে লক্ষ্য করে সমানে কামান দেগে যাওয়া। সেই কাজেই নামানো হয় বফর্সকে।

সমতলে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত গোলা ছুড়ত বফর্স। কার্গিলে পাহাড়ি পথে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ কিলোমিটার। মাত্র ১২ সেকেন্ডে ৩ রাউন্ড গোলা ছুড়ত এই কামান। ভারত প্রথম ধাপে মাত্র ৪০টা কামান নামিয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে ভাঁড়ারে থাকা প্রায় সবকটি বফর্স কামানকেই কার্গিলে নিয়ে যাওয়া হয়।

কারণ ততদিনে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে উঁচু, খাড়াই, পাহাড়ি এলাকায় বফর্স একাই একশো। যুদ্ধের সময়ে এক সেনা কর্তার একটা সিদ্ধান্ত আরও অ্যাডভান্টেজ দিয়েছিল। তিনিই বুদ্ধি দিয়েছিলেন, একটা পাটাতনের উপর রেখে ফায়ার করলে বফর্সের গোলা আরও উঁচুতে যাবে। যুদ্ধের প্রথম থেকে শেষ, এটাই মেনে চলেছিলেন গোলন্দাজরা। বফর্সের গোলায় পাহাড় চূড়োয় থাকা বহু পাকিস্তানি পোস্ট উড়ে গিয়েছিল। পাক সেনারা গোলা সামলাতে ব্যস্ত ছিল। ফলে পাহাড়ে উঠতে অনেকটা বাড়তি সময় পেয়েছিল ভারতীয় সেনা।

আসলে বফর্স বললে, অনেকেরই বফর্স কেলেঙ্কারির কথাটাই মনে পড়ে। সুইডেন থেকে কামান কিনতে ঘুষ নিয়েছেন রাজীব গান্ধী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা। এই অভিযোগে তোলপাড় হয়েছিল দেশের রাজনীতি। বফর্স কামান নিম্নমানের বলেও অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। কার্গিল যুদ্ধে সত্যিটা আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। বফর্সকে বাদ দিয়ে কার্গিলের ইতিহাস লেখাই সম্ভব নয়। তেমনই বফর্স নিয়ে বলতে গেলে বফর্স রাজনীতির কথাও আসবেই আসবে।

সাম্প্রতিককালে কার্গিল যুদ্ধই ছিল গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে উচ্চতম যুদ্ধ। যুদ্ধ চলছিল কার্গিল, সিয়াচেন এবং লাদাখ অঞ্চলে, যে অঞ্চলগুলো সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে অনেক, অনকেটাই উঁচুতে। পাহাড়ের এত উচ্চতায় মানে ৮ হাজার ৭৮০ ফুট, সাম্প্রতিককালে কোনও যুদ্ধ হয়নি। ভারতীয় জওয়ানদের শুধু পাকিস্তানি সেনা জওয়ানদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ছিল না। তাঁদের লড়াই করতে হচ্ছিল প্রবল ঠান্ডার বিরুদ্ধেও। যে সময়ে কার্গিল যুদ্ধ হচ্ছিল, তখন, বেশ কিছু অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও কম।

কার্গিলের লড়াই যতটা কঠিন বলে আমরা জানি, তার চেয়েও বোধহয় কয়েকগুণ কঠিন লড়াই লড়েছিলেন ভারতীয় জওয়ানরা। পাহাড়ের মাথায় বসে থাকা পাক সেনা গুলিবৃষ্টি করে চলেছে। আর পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে পাকিস্তানের তিনজনের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন গড়ে একজন ভারতীয় সেনা। মানে অনুপাতটা ভাবুন, তিন পাক সেনা পিছু এক ভারতীয় সেনা! মনে রাখতে হবে, ভারতীয় সেনার একহাতে দড়ি ধরে উঠছিলেন। অন্য হাতে গুলি চালাচ্ছিলেন। প্রথমে যে প্ল্যান হয়েছিল, বাস্তবে তা খাটছিল না। বাধ্য হয়েই নতুন প্ল্যানিং করতে হয়। সেই পরিস্থিতি কতটা চ্যালেঞ্জ ছিল সেই লড়াই, কী বলছেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন?

একদিকে বফর্স থেকে গোলা, অন্যদিকে আকাশ পথে হামলা। কার্গিল যুদ্ধে ভারতীয় এয়ারফোর্সের সফেদ সাগর অপারেশন খুবই কার্যকর ছিল। প্রথমবার এই যুদ্ধে ভারত ৩২ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছিল। এত উচ্চতায় পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূল হয় যে, প্রশিক্ষিত পাইলটেরও বিমানের ভিতর দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তারপরও অসাধ্য সাধন এবং সেটা মাত্র এক সপ্তাহের প্রস্তুতিতে!