Roman Food Recipe Part II: খানা খানদানি-পর্ব ০২, আপেল সহযোগে বরাহমাংস

TV9 Bangla Digital | Edited By: Sohini chakrabarty

Oct 04, 2021 | 1:05 PM

Roman Food Recipe: Pork With Apple: এক দুরন্ত সস্ রোম সাম্রাজ্য থেকে আমাদের এই পড়শি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে হাজির হওয়ার গপ্পোও লুকিয়ে আছে এ রেসিপিতে—ফিশ সস্।

Follow Us

নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ২

কাল আমরা দেখেছিলাম ‘মিনুটাল মাটিয়ানুম’ ১৬০০ বছর আগে পরিবেশিত রোমান খানা। আজ দেখব সেই খানা খাঁটি বিশ্বায়নের এক দুরন্ত উদাহরণ।

কেন? কারণ তাতে ব্যবহৃত উপকরণগুলি।

তেল। এই রেসিপিটিকেই আধুনিক রূপ দিতে গিয়ে খানা-ইতিহাস বিশারদ অ্যান্ড্রু ড্যালবি ও স্যালি গ্রেইঙ্গার ভেঙে বলেছেন—অলিভ অয়েল, জলপাই তেল। মজার কথা হল, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল নয়, পশ্চিম এশিয়াতেই কিন্তু অলিভ অয়েলের আঁতুড় ঘর। (ছবি ৮) কাজেই পশ্চিম এশিয়ার ফিনিশীয়দের কল্যাণেই রোমান সাম্রাজ্যের হরেক খাদ্য ম-ম করত এই উৎকৃষ্ট তেলের মিষ্টি সুগন্ধে।

এক দুরন্ত সস্ রোম সাম্রাজ্য থেকে আমাদের এই পড়শি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে হাজির হওয়ার গপ্পোও লুকিয়ে আছে এ রেসিপিতে—ফিশ সস্। রোম সাম্রাজ্যের হেঁশেলে এই ফিশ সস্ ছিল অপরিহার্য, নাম ‘গারুম’। আসলে গ্রিকরাই এ সস্ প্রথম তৈরি করে পূর্বসাধারণাব্দ সপ্তম শতকে। নুন দিয়ে মাছ গাঁজিয়ে। টকটকে লাল তরল। নাম ‘গারোস’। আরিস্তোফেনেস, সোফোক্লিস, ইসকুলশ—বাঘা-বাঘা গ্রিক নাট্যকারদের লেখায় এই ‘গারোস’ ভর্তি! সেই ‘গারোস’ রোমে এসে হলো ‘গারুম’। বহু ইতিহাসকার মনে করেন এই ফিশ সস্ সিল্ক রোড ধরে চলতে-চলতে সোজা হাজির হয়েছিল আমাদের পড়শি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। যে অঞ্চল থেকে পশ্চিমে যেত রোমান বিত্তবানদের নেশা— রেশম, সিল্ক। নাও রেশম, দাও সস্! কিন্তু সর্বনাশ! ‘গারুম’ তো সে প্রাচীন কালেই হারিয়ে গিয়েছে। তা হলে এ রান্না হবে কী করে? কুছ পরোয়া নেহি! ২০১০ সালে একদল গবেষক সাধারণাব্দ প্রথম শতকের আজব শহর আগ্নেয়গিরির ছাই-চাপা পম্পেই-র ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া ‘গারুম’ সসের বইয়ামে পাওয়া সসের অবশেষের ওপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালান। ফল দেখে তাঁদের চোখ ছানাবড়া— ওমা! এর ‘টেস্ট প্রোফাইল’ তো হুবহু আজকের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিশ সসের মতো! আর সে তো আমাদের এই কলকাতাতে বসেই অনলাইন কিনে নেওয়া যায়! (ছবি ৯) এই প্রাচীন রোমান সস্ বানানোর তওর-তরিকা আরও বিশদে বুঝে নিতে হলে দেখুন এই ভিডিওটি —

আবার এই খানার থালে রয়েছে একটুকরো সুপ্রাচীন ভারতও। ওই যে—গোলমরিচ। ভারতের যে দুর্মূল্য সম্পদ লুঠ করতে শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশবাদ এ দেশটার সর্বনাশ করে গিয়েছে, এই ‘কালো সোনা’ সে সম্পদের অন্যতম৷ আদিকাল থেকেই দুনিয়াময় ভারতীয় গোলমোরিচ যে কী দাপান দাপিয়ে বেড়াত, তার কুচকুচে প্রমাণ রেখে গিয়েছেন বিখ্যাত রোমান নৌসেনাপতি, মহাচিন্তাবিদ বরিষ্ঠ প্লিনি (Pliny The Elder) তাঁর অসাধারণ বই The Natural History-তে৷ ইতালির বাজারে ভারতীয় মশলার এই মহাদাপটে তাঁর যে মহারাগ, তা পড়লে আজও আমি হেসে কুটিপাটি হই—‘‘…গোলমরিচে এমন কিচ্ছু নেই যার জোরে সে নিজেকে ফল বা ‘বেরি’ হিসেবে সুপারিশের সওয়াল করতে পারে। এর একমাত্র কাম্য গুণ খানিকটা ঝাঁঝ, অথচ শুধু তারই জন্য আমরা সূদূর ভারত থেকে তা আমদানি করি! কে প্রথম এটিকে খাদ্যবস্তু হিসেবে পরীক্ষা করেছিল? এবং কে সেই লোক, আমি ভেবে পাই না, যার কেবল খিদে মিটলেই চলেনি, লোভের খিদেও মিটাতে হয়েছে? তাদের নিজ-নিজ দেশে গোলমরিচ আর আদা দু’টোই গজায় বনবাদাড়ে অকাতরে, আর আমরা কি না তাদের ওজন ধরে কিনে আনি, ঠিক যেন সোনা কিংবা রুপো!’’ প্লিনি সাহেবের এই দূরন্ত বইটি প্রকাশিত হয় ৭৭-৭৯ সাধারণাব্দে৷

এই ছাড়াও আছে জিরে। যার লাতিন নাম ‘কুমিনুম’ এসেছে আরবি ‘কম্মুন’ থেকে। এ মশলা পশ্চিম এশিয়ার, বিশেষ করে ইরানি। তাই তো ফারসি ‘জ়িরেহ্’ থেকে আমাদের জিরে! আবার হিং পূর্ব ইরান, আফগানিস্তানের আদি বাসিন্দা। গ্রিক দেশের ‘মিন্ট’ মানে পুদিনার গপ্পো মজাদার—গ্রিক কিংবদন্তির ‘মিন্থে’ ছিল কোকাইটুস নদীর ‘নিম্ফ’। নিম্ফ কী? প্রাচীন গ্রিক গাথার অতি রূপসী নারী যারা বিভিন্ন স্থানীয় প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন পাহাড়, জলাশয়, নদী ইত্যাদির প্রতিভূ—এক একটির এক-এক জন নিম্ফ। এই মিন্থে একবার পাগল হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর রাজা, পাতালপুরীর সর্বেসর্বা হাডেস-কে ফুসলিয়ে নিজের করে নেবে বলে। হাডেসের স্ত্রী রানি পার্সেফোন সেই না দেখে মন্ত্রবলে সেই মিন্থে নিম্ফ কে করে দিল বাগানের ‘মিন্ট’!

 

এইভাবেই দুনিয়ার গল্পগাছা কিংবদন্তিতে হরেক খানদানি খানা ভরপুর—খাঁটি বিশ্বায়নের অতি সুস্বাদু নিদর্শন!

এইবার তবে হাতে-খুন্তিতে লেগে পড়া যাক। আজ থেকে ষোলশো বছর আগের রান্না কোনও বাঙালি বাড়িতে এক্কেবারে হুবহু করা অসম্ভব। কাজেই, আমরা রদবদল করব, ততটাই যাতে মূল স্বাদটা মোটামুটি একই থাকে। ড্যালবি সাহেব ও গ্রেইঙ্গার মেম সাহেব নিজেরাই সে কাজটা অনেকটা করে গিয়েছেন, এ খানার আধুনিক রেসিপি দিয়ে। আমরা সেটাই নেব শুধু দু-একটি পরিবর্তন ছাড়া।—

মিনুটাল মাটিয়ানুম (আধুনিক)

৪ জনের জন্য

উপকরণ

৪৫০ গ্রাম চর্বিশুদ্ধ পোর্ক (ড্যালবি-গ্রেইঙ্গার চর্বিহীন পোর্ক নিতে বলেছেন স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। আমার প্রস্তাব কম চর্বিওয়ালা নিন, কিন্তু একেবারে ‘লিন’ নয়)
৯০ গ্রাম মধু
১টি তেজ পাতা
১ গাছি সেলেরি ডাঁটা (কুচি করা)
৫টি গোটা গোলমরিচ
২২৫ গ্রাম লিন পোর্ক মিহি কিমা (মিট বল্স করার জন্য। আপিকিয়ুসে কোন মাংস বলা নেই। ড্যালবি-গ্রেইঙ্গার কেন বিফ নিতে বলেছেন জানি না। আমার মতে পোর্ক-ই হওয়া উচিত)
১টি ডিম (ফ্যাটানো)
১টি বড় পেঁয়াজ (কুচি করা)
১ মুঠি তাজা ধনে পাতা (কুচোনো)
৪৫০ গ্রাম মিষ্টি আপেল (ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করা)
২৮০ মি.লি. হোয়াইট ওয়াইন
১৫০ মি.লি. হোয়াইট ওয়াইন ভিনিগার (আপিকিয়ুস বলছে ‘মাস্ট’। লাল আঙুর ছাল-সহ মিক্সারে জুস করে তা ফুটিয়ে ঘন করে নিলেও চলবে)
৩০ মি.লি. অলিভ অয়েল
১৫০ মি.লি. ফিশ সস্
২ চা-চামচ জিরে বাটা
১ চা-চামচ হিং
২ চা-চামচ পুদিনা পাতা কুচি
কর্ন ফ্লাওয়ার প্রয়োজন মতো (আপিকিয়ুস যে পেস্ট্রির গুড়ো দিয়ে বলেছে তার পরিবর্তে)
প্রয়োজন মতো তাজা গোলমরিচ গুঁড়ো (গোটা-গোল মরিচ তাওয়ায় হাল্কা সেঁকে, ঠাণ্ডা করে বাড়িতে গুঁড়ো করলে ভাল হয়)।
নুন স্বাদ মতো

প্রকরণ

১। প্রথমেই পোর্ক কিমাতে নুন, গোলমরিচ, ফ্যাটানো ডিম, অল্প কর্নফ্লাওয়ার (নইলে বলগুলো রান্নার সময় ভেঙে যাবেই) মিশিয়ে আটটা গোল্লা পাকিয়ে নিন।
২। প্যানে অল্প তেল দিয়ে হাল্কা করে ভেজে তুলে রাখুন (তেল গরম হলে ছাড়ুন। সঙ্গে-সঙ্গে নাড়বেন না। রঙ বদলালে চামচ দিয়ে নেড়ে উলটে-পালটে ভাজতে হবে)।
৩। কানা উঁচু পাত্রে পোর্ক (ছোট টুকরো করা), সেলেরি কুচি, তেজ পাতা, গোটা গোলমরিচ, ১ চামচ মধু, জল দিয়ে সিদ্ধ বসান। জল ফুটলেই আঁচ কমিয়ে মাংস আধ-সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত সিদ্ধ করুন। নামিয়ে ঠাণ্ডা হতে দিন।
৪। পেঁয়াজ কুচি, ধনে পাতা কুচি, আপেলের টুকরো, হোয়াইট ওয়াইন, দেড় কাপ পোর্ক-সিদ্ধ ঝোল, ভিনিগার (বা আঙুরের রস), ফিশ সস্, বাকি ২ চামচ মধু এক সঙ্গে একটা বড় পাত্রে দিয়ে হাল্কা আঁচে ফুটতে দিন।
৫। এই ফুটন্ত তরলে আধ-সিদ্ধ পোর্কের টুকরো দিন। ৩০ মিনিট সিদ্ধ করুন। দরকার হলে আরও পোর্ক-সিদ্ধ ঝোল অল্প-অল্প করে দিন।
৬। ধনে পাতা, বাটা জিরে, হিং যোগ করুন, ভাজা মাংসের বলগুলো যোগ করুন বাকি পোক-সিদ্ধ ঝোল দিন। আপেলের ও মাংসের টুকরো নরম হয়ে যাবে। স্বাদ মতো নুন আর গোলমরিচ গুঁড়ো দিন।
৭। ফুটতে দিন, একটু পরে অল্প কর্নফ্লাওয়ার একটা কাপে ভাল করে জলে গুলে ফুটন্ত পাত্রে ছড়িয়ে, স্বাদ মতো নুন দিয়ে নেড়েচেড়ে ঝোলটা ঘন করুন।
৮। ধনেপাতা গার্নিশ করে পরিবেশন করুন ভাল চালের ভাত বা স্পাঘেত্তি পাস্তার সঙ্গে।

আপনার টেবিলে হাজির রোম সাম্রাজ্যের এক হাজার ছ’শো বছর প্রাচীন খানদানি খানা!

আরও পড়ুন- Roman Food Recipe Part I: খানা খানদানি-পর্ব ০১, আপেল সহযোগে বরাহমাংস

খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার 

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ২

কাল আমরা দেখেছিলাম ‘মিনুটাল মাটিয়ানুম’ ১৬০০ বছর আগে পরিবেশিত রোমান খানা। আজ দেখব সেই খানা খাঁটি বিশ্বায়নের এক দুরন্ত উদাহরণ।

কেন? কারণ তাতে ব্যবহৃত উপকরণগুলি।

তেল। এই রেসিপিটিকেই আধুনিক রূপ দিতে গিয়ে খানা-ইতিহাস বিশারদ অ্যান্ড্রু ড্যালবি ও স্যালি গ্রেইঙ্গার ভেঙে বলেছেন—অলিভ অয়েল, জলপাই তেল। মজার কথা হল, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল নয়, পশ্চিম এশিয়াতেই কিন্তু অলিভ অয়েলের আঁতুড় ঘর। (ছবি ৮) কাজেই পশ্চিম এশিয়ার ফিনিশীয়দের কল্যাণেই রোমান সাম্রাজ্যের হরেক খাদ্য ম-ম করত এই উৎকৃষ্ট তেলের মিষ্টি সুগন্ধে।

এক দুরন্ত সস্ রোম সাম্রাজ্য থেকে আমাদের এই পড়শি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে হাজির হওয়ার গপ্পোও লুকিয়ে আছে এ রেসিপিতে—ফিশ সস্। রোম সাম্রাজ্যের হেঁশেলে এই ফিশ সস্ ছিল অপরিহার্য, নাম ‘গারুম’। আসলে গ্রিকরাই এ সস্ প্রথম তৈরি করে পূর্বসাধারণাব্দ সপ্তম শতকে। নুন দিয়ে মাছ গাঁজিয়ে। টকটকে লাল তরল। নাম ‘গারোস’। আরিস্তোফেনেস, সোফোক্লিস, ইসকুলশ—বাঘা-বাঘা গ্রিক নাট্যকারদের লেখায় এই ‘গারোস’ ভর্তি! সেই ‘গারোস’ রোমে এসে হলো ‘গারুম’। বহু ইতিহাসকার মনে করেন এই ফিশ সস্ সিল্ক রোড ধরে চলতে-চলতে সোজা হাজির হয়েছিল আমাদের পড়শি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। যে অঞ্চল থেকে পশ্চিমে যেত রোমান বিত্তবানদের নেশা— রেশম, সিল্ক। নাও রেশম, দাও সস্! কিন্তু সর্বনাশ! ‘গারুম’ তো সে প্রাচীন কালেই হারিয়ে গিয়েছে। তা হলে এ রান্না হবে কী করে? কুছ পরোয়া নেহি! ২০১০ সালে একদল গবেষক সাধারণাব্দ প্রথম শতকের আজব শহর আগ্নেয়গিরির ছাই-চাপা পম্পেই-র ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া ‘গারুম’ সসের বইয়ামে পাওয়া সসের অবশেষের ওপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালান। ফল দেখে তাঁদের চোখ ছানাবড়া— ওমা! এর ‘টেস্ট প্রোফাইল’ তো হুবহু আজকের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিশ সসের মতো! আর সে তো আমাদের এই কলকাতাতে বসেই অনলাইন কিনে নেওয়া যায়! (ছবি ৯) এই প্রাচীন রোমান সস্ বানানোর তওর-তরিকা আরও বিশদে বুঝে নিতে হলে দেখুন এই ভিডিওটি —

আবার এই খানার থালে রয়েছে একটুকরো সুপ্রাচীন ভারতও। ওই যে—গোলমরিচ। ভারতের যে দুর্মূল্য সম্পদ লুঠ করতে শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশবাদ এ দেশটার সর্বনাশ করে গিয়েছে, এই ‘কালো সোনা’ সে সম্পদের অন্যতম৷ আদিকাল থেকেই দুনিয়াময় ভারতীয় গোলমোরিচ যে কী দাপান দাপিয়ে বেড়াত, তার কুচকুচে প্রমাণ রেখে গিয়েছেন বিখ্যাত রোমান নৌসেনাপতি, মহাচিন্তাবিদ বরিষ্ঠ প্লিনি (Pliny The Elder) তাঁর অসাধারণ বই The Natural History-তে৷ ইতালির বাজারে ভারতীয় মশলার এই মহাদাপটে তাঁর যে মহারাগ, তা পড়লে আজও আমি হেসে কুটিপাটি হই—‘‘…গোলমরিচে এমন কিচ্ছু নেই যার জোরে সে নিজেকে ফল বা ‘বেরি’ হিসেবে সুপারিশের সওয়াল করতে পারে। এর একমাত্র কাম্য গুণ খানিকটা ঝাঁঝ, অথচ শুধু তারই জন্য আমরা সূদূর ভারত থেকে তা আমদানি করি! কে প্রথম এটিকে খাদ্যবস্তু হিসেবে পরীক্ষা করেছিল? এবং কে সেই লোক, আমি ভেবে পাই না, যার কেবল খিদে মিটলেই চলেনি, লোভের খিদেও মিটাতে হয়েছে? তাদের নিজ-নিজ দেশে গোলমরিচ আর আদা দু’টোই গজায় বনবাদাড়ে অকাতরে, আর আমরা কি না তাদের ওজন ধরে কিনে আনি, ঠিক যেন সোনা কিংবা রুপো!’’ প্লিনি সাহেবের এই দূরন্ত বইটি প্রকাশিত হয় ৭৭-৭৯ সাধারণাব্দে৷

এই ছাড়াও আছে জিরে। যার লাতিন নাম ‘কুমিনুম’ এসেছে আরবি ‘কম্মুন’ থেকে। এ মশলা পশ্চিম এশিয়ার, বিশেষ করে ইরানি। তাই তো ফারসি ‘জ়িরেহ্’ থেকে আমাদের জিরে! আবার হিং পূর্ব ইরান, আফগানিস্তানের আদি বাসিন্দা। গ্রিক দেশের ‘মিন্ট’ মানে পুদিনার গপ্পো মজাদার—গ্রিক কিংবদন্তির ‘মিন্থে’ ছিল কোকাইটুস নদীর ‘নিম্ফ’। নিম্ফ কী? প্রাচীন গ্রিক গাথার অতি রূপসী নারী যারা বিভিন্ন স্থানীয় প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন পাহাড়, জলাশয়, নদী ইত্যাদির প্রতিভূ—এক একটির এক-এক জন নিম্ফ। এই মিন্থে একবার পাগল হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর রাজা, পাতালপুরীর সর্বেসর্বা হাডেস-কে ফুসলিয়ে নিজের করে নেবে বলে। হাডেসের স্ত্রী রানি পার্সেফোন সেই না দেখে মন্ত্রবলে সেই মিন্থে নিম্ফ কে করে দিল বাগানের ‘মিন্ট’!

 

এইভাবেই দুনিয়ার গল্পগাছা কিংবদন্তিতে হরেক খানদানি খানা ভরপুর—খাঁটি বিশ্বায়নের অতি সুস্বাদু নিদর্শন!

এইবার তবে হাতে-খুন্তিতে লেগে পড়া যাক। আজ থেকে ষোলশো বছর আগের রান্না কোনও বাঙালি বাড়িতে এক্কেবারে হুবহু করা অসম্ভব। কাজেই, আমরা রদবদল করব, ততটাই যাতে মূল স্বাদটা মোটামুটি একই থাকে। ড্যালবি সাহেব ও গ্রেইঙ্গার মেম সাহেব নিজেরাই সে কাজটা অনেকটা করে গিয়েছেন, এ খানার আধুনিক রেসিপি দিয়ে। আমরা সেটাই নেব শুধু দু-একটি পরিবর্তন ছাড়া।—

মিনুটাল মাটিয়ানুম (আধুনিক)

৪ জনের জন্য

উপকরণ

৪৫০ গ্রাম চর্বিশুদ্ধ পোর্ক (ড্যালবি-গ্রেইঙ্গার চর্বিহীন পোর্ক নিতে বলেছেন স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। আমার প্রস্তাব কম চর্বিওয়ালা নিন, কিন্তু একেবারে ‘লিন’ নয়)
৯০ গ্রাম মধু
১টি তেজ পাতা
১ গাছি সেলেরি ডাঁটা (কুচি করা)
৫টি গোটা গোলমরিচ
২২৫ গ্রাম লিন পোর্ক মিহি কিমা (মিট বল্স করার জন্য। আপিকিয়ুসে কোন মাংস বলা নেই। ড্যালবি-গ্রেইঙ্গার কেন বিফ নিতে বলেছেন জানি না। আমার মতে পোর্ক-ই হওয়া উচিত)
১টি ডিম (ফ্যাটানো)
১টি বড় পেঁয়াজ (কুচি করা)
১ মুঠি তাজা ধনে পাতা (কুচোনো)
৪৫০ গ্রাম মিষ্টি আপেল (ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করা)
২৮০ মি.লি. হোয়াইট ওয়াইন
১৫০ মি.লি. হোয়াইট ওয়াইন ভিনিগার (আপিকিয়ুস বলছে ‘মাস্ট’। লাল আঙুর ছাল-সহ মিক্সারে জুস করে তা ফুটিয়ে ঘন করে নিলেও চলবে)
৩০ মি.লি. অলিভ অয়েল
১৫০ মি.লি. ফিশ সস্
২ চা-চামচ জিরে বাটা
১ চা-চামচ হিং
২ চা-চামচ পুদিনা পাতা কুচি
কর্ন ফ্লাওয়ার প্রয়োজন মতো (আপিকিয়ুস যে পেস্ট্রির গুড়ো দিয়ে বলেছে তার পরিবর্তে)
প্রয়োজন মতো তাজা গোলমরিচ গুঁড়ো (গোটা-গোল মরিচ তাওয়ায় হাল্কা সেঁকে, ঠাণ্ডা করে বাড়িতে গুঁড়ো করলে ভাল হয়)।
নুন স্বাদ মতো

প্রকরণ

১। প্রথমেই পোর্ক কিমাতে নুন, গোলমরিচ, ফ্যাটানো ডিম, অল্প কর্নফ্লাওয়ার (নইলে বলগুলো রান্নার সময় ভেঙে যাবেই) মিশিয়ে আটটা গোল্লা পাকিয়ে নিন।
২। প্যানে অল্প তেল দিয়ে হাল্কা করে ভেজে তুলে রাখুন (তেল গরম হলে ছাড়ুন। সঙ্গে-সঙ্গে নাড়বেন না। রঙ বদলালে চামচ দিয়ে নেড়ে উলটে-পালটে ভাজতে হবে)।
৩। কানা উঁচু পাত্রে পোর্ক (ছোট টুকরো করা), সেলেরি কুচি, তেজ পাতা, গোটা গোলমরিচ, ১ চামচ মধু, জল দিয়ে সিদ্ধ বসান। জল ফুটলেই আঁচ কমিয়ে মাংস আধ-সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত সিদ্ধ করুন। নামিয়ে ঠাণ্ডা হতে দিন।
৪। পেঁয়াজ কুচি, ধনে পাতা কুচি, আপেলের টুকরো, হোয়াইট ওয়াইন, দেড় কাপ পোর্ক-সিদ্ধ ঝোল, ভিনিগার (বা আঙুরের রস), ফিশ সস্, বাকি ২ চামচ মধু এক সঙ্গে একটা বড় পাত্রে দিয়ে হাল্কা আঁচে ফুটতে দিন।
৫। এই ফুটন্ত তরলে আধ-সিদ্ধ পোর্কের টুকরো দিন। ৩০ মিনিট সিদ্ধ করুন। দরকার হলে আরও পোর্ক-সিদ্ধ ঝোল অল্প-অল্প করে দিন।
৬। ধনে পাতা, বাটা জিরে, হিং যোগ করুন, ভাজা মাংসের বলগুলো যোগ করুন বাকি পোক-সিদ্ধ ঝোল দিন। আপেলের ও মাংসের টুকরো নরম হয়ে যাবে। স্বাদ মতো নুন আর গোলমরিচ গুঁড়ো দিন।
৭। ফুটতে দিন, একটু পরে অল্প কর্নফ্লাওয়ার একটা কাপে ভাল করে জলে গুলে ফুটন্ত পাত্রে ছড়িয়ে, স্বাদ মতো নুন দিয়ে নেড়েচেড়ে ঝোলটা ঘন করুন।
৮। ধনেপাতা গার্নিশ করে পরিবেশন করুন ভাল চালের ভাত বা স্পাঘেত্তি পাস্তার সঙ্গে।

আপনার টেবিলে হাজির রোম সাম্রাজ্যের এক হাজার ছ’শো বছর প্রাচীন খানদানি খানা!

আরও পড়ুন- Roman Food Recipe Part I: খানা খানদানি-পর্ব ০১, আপেল সহযোগে বরাহমাংস

খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার 

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
Next Article