ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার ভাল করে আবিষ্কার করে বিকেল পাঁচটার মধ্যে নিচে ঘাঙ্গরিয়ার গুরুদ্বারে আশ্রয় নিলাম। আমার লাগেজপত্র এখানেই ছিল। শুধু একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে তাতে খাবার এবং আরেকটি জলের বোতল নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আপনার বেশিরভাগ সময়টা এখানেই দেবেন, কারণ আপনি যত ভিতরে যাবেন তত দেখতে পারবেন নানা ধরনের ফুল এবং পাহাড়ের বৈচিত্র্য। কোথাও আবার এই ফুলের উপত্যকা এতটাই ঘন যে সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। অনেকটা দূর গেলে আপনি দেখতে পাবেন একটি ছোট্ট নদী আর এখানে চারিপাশের পাহাড়। অদ্ভুত ধরনের সুন্দর। মনে হবে যেন উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড়গুলো আপনার কাছে চলে এসেছে।
বিকেলে গুরুদ্বারে এসে একটু শরীরটাকে বিশ্রাম দিয়ে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম কারণ পরের দিন সকালে আবারো ছয় কিলোমিটার পথ চলা। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার থেকে হেমকুন্ড সাহিব গুরুদ্বার আরও অনেকটা উঁচু। তাই শরীরকে বেশ ধকল সইতে হবে। তাই সময় নষ্ট না করে রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমও ভাল হল। পরের দিন সকাল পাঁচটায় বেরিয়ে পড়লাম হেমকুন্ড সাহিবের উদ্দেশ্যে। রাস্তা প্রচণ্ড সরু ও খাড়াই, রাস্তার পাশের পাহাড়গুলো যেন মাথায় পড়লেই বাঁচে। কখনও রোদের আলো, আবার কখনও চলে আসা একঝাঁক মেঘে অদ্ভুত বৈচিত্র ধারণ করে এই পাহাড়গুলো।
হেমকুন্ড সাহিব পৌঁছানোর এক কিলোমিটার আগে পাবেন একটি বড় গ্লেসিয়ার। গ্লেসিয়ার পেরিয়ে আরেকটু দূরে গেলেই দেখতে পাবেন গুরুদ্বারের চূড়া এবং চারপাশে পাহাড়ে ওপর অবস্থিত ছোট-ছোট মন্দির। যা নির্দিষ্ট স্থানে না গেলে আপনি দেখতে পাবেন না। এই ছোট ছোট মন্দিরগুলোকে দেখার জন্য আপনি কোনও এক তীর্থযাত্রীর সাহায্য নিতে পারেন। শুধু তাঁরাই জানেন এই মন্দিরগুলির অবস্থান। মাথার উপরে থাকা এই মন্দিরগুলিকে দেখতে দেখতে কখন যে গুরুদ্বারে পৌঁছে যাবেন তা বুঝতেও পারবেন না।
এই হেমকুন্ড সাহিবে অবস্থিত একটি পবিত্র লেক, যার মধ্যে থাকা মন্দিরের প্রতিচ্ছবি এবং পাহাড়ের অবস্থান আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে। এখানে পৌঁছেই আপনার মনে হবে যেন একটা অন্য জায়গায় চলে এসেছি। আর এই লেকের জলের স্বচ্ছতা, চারপাশের বৈচিত্র আর এখানে শীতল ঠান্ডা হওয়া, এছাড়াও মন্দিরের সংকীর্তন আপনাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যাবে। এছাড়াও আছে এখানে তাদের প্রসাদ এবং গরম গরম চা আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে। এখানে তীর্থযাত্রীদের থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই তাই বিকেলের পরেই আপনাকে এখান থেকে নামতে হবে।
আর এখানেই পাবেন আপনি ব্রহ্মকমলে রসন্ধান। এছাড়াও নানান ধরনের বৈচিত্র্যময় ফুলও রয়েছে। আর এই ব্রহ্মকমল পাওয়ার সঠিক ঠিকানা হল, এই গুরুদ্বারে প্রবেশ করার পর দেখবেন আপনার ডান পাশে একটি পাহাড় উপরে উঠে গেছে। এই পাহাড়ের বেশ কিছুটা উপরে উঠে পাহাড়ের এক ডালেই দেখতে পাবেন প্রচুর ব্রহ্মকমল ফুটে আছে। নিচ থেকে এগুলিকে দেখা যায় না তার কারণ এগুলি প্রায়ই মেঘে ঢেকে থাকে। সঠিক আবহাওয়া এবং সঠিক সময় না পেলে এই ব্রহ্মকমল ফোটে না। অগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই ব্রহ্মকমল ফোটে। এই ফুলের গন্ধ ও বৈচিত্র এক অদ্ভুত মোহময়। পরের দিন যেহেতু বদ্রীনাথ যাওয়ার প্ল্যান আছে, তাই দুটি ব্রহ্মকমল নিয়েছিলাম দেবতার চরণে অর্পণ করার জন্য। দুটি ফুল ছেড়ার পরে তার ওই যে গন্ধ আজও ভুলবার নয়। যতক্ষণ এই ফুল দুটি আমার কাছে ছিল ততক্ষণ তার গন্ধ কোনও অংশে কমেনি। এর সঙ্গে একটি কথা বলে রাখা খুবই দরকার, এই পাহাড়ে ওঠার আগে এখানে থাকা প্রতিরক্ষার মানুষদের জানানো খুবই দরকার। আপনার কিছু হয়ে গেলে তাদের উপর নানা ধরনের অসুবিধা হতে পারে তাই তাদের জানিয়ে অবশ্যই এখানের পাহাড়ে উঠবেন ।
এখানে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে দুপুর দুটো নাগাদ উপর থেকে নিচে নেমে ঘাঙ্গরিয়ার গুরুদ্বার থেকে লাগেজপত্র গুছিয়ে সোজা নিচে নেমে আসলাম গোবিন্দঘাটের গুরুদ্বারে। এখানে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। এখানে পৌঁছে বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম, পরের দিনের যাত্রা বদ্রিনাথ এবং মানা গ্রামের উদ্দেশে।
সকাল সকাল ফ্রেশ হয়ে লাগেজপত্র নিয়ে গুরুদ্বার থেকে বেরিয়ে পড়লাম বাইক নিয়ে। আজকের দিনের প্রথম গন্তব্যস্থান বদ্রিনাথ ধামের উদ্দেশে। সকাল সকাল মন্দিরের ভিড় কিছুটা কম থাকায় একটু লাইনে দাঁড়িয়েই ব্রহ্মকমল দিয়ে ভগবানের দর্শন করে বেরিয়ে পড়লাম মন্দিরে ঠিক পেছনেই অবস্থিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেটির নাম ভগবান বিষ্ণুর পায়ের ছাপ। এই স্থান থেকে পাহাড়ের বৈচিত্র এবং সম্পূর্ণ গ্রামটাকে খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায় আর তার সঙ্গে আছে একটি অসাধারণ সুন্দর ঝর্ণা।
এখান থেকে নিচে নেমে বাইক নিয়ে চলে আসলাম ভারতের ‘প্রথম’ গ্রাম যেটির নাম মানা গ্রাম। আর এটি হল আজকের দিনের রাত কাটানোর স্থান। একটি ছোট্ট পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সুন্দর একটি গ্রাম।
উত্তরাখন্ড ডায়েরি পরবর্তী অংশ রয়েছে আগামী পর্বে।