প্রান্তিকা আড়ি, স্কুলশিক্ষিকা
যাই হোক, মোটামুটি দুপুর আড়াইটা নাগাদ পৌঁছলাম টপে। দেওরিয়াতালের পাঁচশ মিটার আগে শেষ ক্যাম্পসাইট। আসলে তালটি নন্দাদেবী বায়োস্ফিয়ারের অন্তর্গত হওয়ায় এর নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে নিশিযাপন নিষিদ্ধ করেছে উত্তরাখণ্ড সরকার। পাহাড়ের বুকে টুপ করে সন্ধে নেমে আসে, আর হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি। সেইসব মাথায় রেখে তাড়াতাড়ি আমরা তাঁবু খাটিয়ে নিলাম পাহাড়ের ঢালে একটু চটান মত জায়গায়। লাল রডোড্রেনডন গাছের তলায় সন্দীপ ভাইসাব এর নীলকন্ঠ হোটেলের পাশটিতে। তবে এখানে দু তিনটি দোকান এবং তাঁদেরই ভাড়ার তাঁবু আছে রাত্রিবাসের জন্যে।
নীলকণ্ঠ হোটেল থেকে চা আর ম্যাগি খেয়ে বের হলাম দেউরিয়াতাল দেখতে। ততক্ষণে একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গিয়েছে। তাই তাল’এর আশেপাশে কোনও টুরিষ্ট নেই। সূর্যের আলোও কমতে শুরু করেছে। দেউরিয়াতালের বুকে বেশ এক ঘন জমাট বাঁধা অন্ধকার দেখে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। হিমালয়ের কোলে এসে এটাই সবচেয়ে দুঃখের, যদি মেঘের ঘোমটায় মুখ থেকে রেখে থাকে অভিমানী। হঠাৎ আমাদের ডান দিকে চৌখাম্বার দিকে মুখ করে ত্রিশ- চল্লিশ ফুটের মধ্যে দেখি তিনটি হরিন ছানা। ভালো করে দেখলাম আবার। আরে নিশ্চিত, এ তো কস্তুরীমৃগ ( Musk deer), যে প্রজননকালে তার নাভীনিঃসৃত সুগন্ধের সুখ্যাতি বিশ্বব্যাপী। আস্তে আস্তে অন্ধকার গাঢ় হতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলে রাত্রে বন্যপ্রানীরা জলপান করতে আসে বলে বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন সন্দীপ ভাই। সেই কথা মাথায় রেখে তাঁবুতে ফেরার পথে পা বাড়াই। পাহাড়ে রাত্রি নামে ঝুপ করে। সাতটা নাগাদ নৈশাহার শেষ করে টেণ্টে এসে শুয়ে পড়ে স্লিপিং ব্যাগে। তখন তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে প্রায় ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর কাছাকাছি। এতদিন পপ্যন্ত কখনও গোটা একটি দিন বা রাত্রি একবিন্দু আলো ছাড়া কোথাও থাকিনি। এবারের এই প্রথম বিদুৎহীন রাত্রিযাপন। চারিদিকে পার্বত্য জঙ্গলভূমির নিকষ কালো অন্ধকারের অখন্ড নিরবতার মাঝে শুকনো পাতার উপর দিয়ে কোনও জানোয়ারের পা ফেলার শব্দ ওটা!!
শেষ অবধি কখন যে পথশ্রমের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে বুঝতে পারলাম না। তখন চোখ খুলি দেখি তখন তখন ঘড়িতে ভোর ৪ টে।পাহাড়ে সূর্য ওঠেও খুব তাড়াতাড়ি। তড়িঘড়ি কোনওক্রমে তৈরি হয়ে ছুট, ছুট, ছুট……. না এখনও সূর্যদেবের সোনা রোদ্দুর পাহাড়ের মাথা স্পর্শ করেনি। তাল’এর পশ্চিমপাড় এ ঘাসের উপর বসলাম দুজনে। আস্তে আস্তে সামনে চৌখাম্বা, ত্রিশুল মাথায় সোনার মুকুট পড়ে নতুন দিনকে স্বাগত জানাল। সেই রাজবেশের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ল এই মায়ামুকুর দেউরিয়াতাল এর জলে।কী অপূর্ব সেই দৃশ্য! সেই সোনা রোদ ধীরে ধীরে পুরো পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এলো নীচে আরো নীচে… উপত্যকায় তারপর জঙ্গলের পথ পেরিয়ে তাল’এর পাশের সবুজ ঘাসের চাদর পেরিয়ে আরও নীচে চলে গেল।
সূর্য উঠতে দেখলাম হ্রদটি বেশ বড়, উত্তর- দক্ষিণে প্রশস্ত। বামদিকে বেশ সুন্দর সবুজ ঘাসের গালিচা। এর দক্ষিণ- পূর্ব কোণ বরাবর একটি ওয়াচ টাওয়ার অবস্থিত। তার উপরে উঠলে চারপাশের বেশ অনেকটা দৃশ্যমান হয়। ঘন জঙ্গল, দূরে পাহাড়ের শ্রেণীবিন্যাস মনকে বেশ আপ্লুত করে তোলে। ওয়াচ টাওয়ার এর ধার ঘেঁষে আরও একটা রাস্তা জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করেছে যা নাকি সুন্দর এক বুগিয়াল পেরিয়ে তুঙ্গনাথের চরণে গিয়ে শেষ হয়েছে। তবে এই রাস্তায় বুনো ভালুক আর জাগুয়ারের খুব উৎপাত, সঙ্গে খাবার জলের খুব অভাব। তাই দুজনে আর এগোবার সাহস করলাম না ওপরে।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে পুরো তালটা ঘুরে দেখলাম। স্বচ্ছ জল, তাল’এর নীচে পাতাঝাঁঝি মত কোনও এক জলজ গাছের বিস্তার । আর পুরো সময় জুড়ে সামনের ক্যানভাসে হিমালয়ের সাথে মেঘ রোদ্দুরের খেলা। যতই দেখি ততই মনে ভরে যায়। যাত্রী মোটে সারাদিন এ গোটা কুড়িক। তাই সেই নির্জন ঘাসের গালিচায় বসে অনন্ত সে দৃশ্যর স্বাদগ্রহন করতে বেশ ভালোই লাগে।
এবার আমাদের ফেরার পালা। তিনটে দিনে হিমালয় আমাদের দুহাতে ভরিয়ে দিয়েছে। স্হানীয়দের কথায় শীতে নাকি আরো অন্যরকম রূপ…আরো বেশী মোহময়ী। অপেক্ষায় রইলাম ভবিষ্যতে কখনও সেই শীতের রূপ দর্শনের।
(শেষ)
প্রান্তিকা আড়ি, স্কুলশিক্ষিকা
যাই হোক, মোটামুটি দুপুর আড়াইটা নাগাদ পৌঁছলাম টপে। দেওরিয়াতালের পাঁচশ মিটার আগে শেষ ক্যাম্পসাইট। আসলে তালটি নন্দাদেবী বায়োস্ফিয়ারের অন্তর্গত হওয়ায় এর নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে নিশিযাপন নিষিদ্ধ করেছে উত্তরাখণ্ড সরকার। পাহাড়ের বুকে টুপ করে সন্ধে নেমে আসে, আর হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি। সেইসব মাথায় রেখে তাড়াতাড়ি আমরা তাঁবু খাটিয়ে নিলাম পাহাড়ের ঢালে একটু চটান মত জায়গায়। লাল রডোড্রেনডন গাছের তলায় সন্দীপ ভাইসাব এর নীলকন্ঠ হোটেলের পাশটিতে। তবে এখানে দু তিনটি দোকান এবং তাঁদেরই ভাড়ার তাঁবু আছে রাত্রিবাসের জন্যে।
নীলকণ্ঠ হোটেল থেকে চা আর ম্যাগি খেয়ে বের হলাম দেউরিয়াতাল দেখতে। ততক্ষণে একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গিয়েছে। তাই তাল’এর আশেপাশে কোনও টুরিষ্ট নেই। সূর্যের আলোও কমতে শুরু করেছে। দেউরিয়াতালের বুকে বেশ এক ঘন জমাট বাঁধা অন্ধকার দেখে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। হিমালয়ের কোলে এসে এটাই সবচেয়ে দুঃখের, যদি মেঘের ঘোমটায় মুখ থেকে রেখে থাকে অভিমানী। হঠাৎ আমাদের ডান দিকে চৌখাম্বার দিকে মুখ করে ত্রিশ- চল্লিশ ফুটের মধ্যে দেখি তিনটি হরিন ছানা। ভালো করে দেখলাম আবার। আরে নিশ্চিত, এ তো কস্তুরীমৃগ ( Musk deer), যে প্রজননকালে তার নাভীনিঃসৃত সুগন্ধের সুখ্যাতি বিশ্বব্যাপী। আস্তে আস্তে অন্ধকার গাঢ় হতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলে রাত্রে বন্যপ্রানীরা জলপান করতে আসে বলে বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন সন্দীপ ভাই। সেই কথা মাথায় রেখে তাঁবুতে ফেরার পথে পা বাড়াই। পাহাড়ে রাত্রি নামে ঝুপ করে। সাতটা নাগাদ নৈশাহার শেষ করে টেণ্টে এসে শুয়ে পড়ে স্লিপিং ব্যাগে। তখন তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে প্রায় ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর কাছাকাছি। এতদিন পপ্যন্ত কখনও গোটা একটি দিন বা রাত্রি একবিন্দু আলো ছাড়া কোথাও থাকিনি। এবারের এই প্রথম বিদুৎহীন রাত্রিযাপন। চারিদিকে পার্বত্য জঙ্গলভূমির নিকষ কালো অন্ধকারের অখন্ড নিরবতার মাঝে শুকনো পাতার উপর দিয়ে কোনও জানোয়ারের পা ফেলার শব্দ ওটা!!
শেষ অবধি কখন যে পথশ্রমের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে বুঝতে পারলাম না। তখন চোখ খুলি দেখি তখন তখন ঘড়িতে ভোর ৪ টে।পাহাড়ে সূর্য ওঠেও খুব তাড়াতাড়ি। তড়িঘড়ি কোনওক্রমে তৈরি হয়ে ছুট, ছুট, ছুট……. না এখনও সূর্যদেবের সোনা রোদ্দুর পাহাড়ের মাথা স্পর্শ করেনি। তাল’এর পশ্চিমপাড় এ ঘাসের উপর বসলাম দুজনে। আস্তে আস্তে সামনে চৌখাম্বা, ত্রিশুল মাথায় সোনার মুকুট পড়ে নতুন দিনকে স্বাগত জানাল। সেই রাজবেশের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ল এই মায়ামুকুর দেউরিয়াতাল এর জলে।কী অপূর্ব সেই দৃশ্য! সেই সোনা রোদ ধীরে ধীরে পুরো পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এলো নীচে আরো নীচে… উপত্যকায় তারপর জঙ্গলের পথ পেরিয়ে তাল’এর পাশের সবুজ ঘাসের চাদর পেরিয়ে আরও নীচে চলে গেল।
সূর্য উঠতে দেখলাম হ্রদটি বেশ বড়, উত্তর- দক্ষিণে প্রশস্ত। বামদিকে বেশ সুন্দর সবুজ ঘাসের গালিচা। এর দক্ষিণ- পূর্ব কোণ বরাবর একটি ওয়াচ টাওয়ার অবস্থিত। তার উপরে উঠলে চারপাশের বেশ অনেকটা দৃশ্যমান হয়। ঘন জঙ্গল, দূরে পাহাড়ের শ্রেণীবিন্যাস মনকে বেশ আপ্লুত করে তোলে। ওয়াচ টাওয়ার এর ধার ঘেঁষে আরও একটা রাস্তা জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করেছে যা নাকি সুন্দর এক বুগিয়াল পেরিয়ে তুঙ্গনাথের চরণে গিয়ে শেষ হয়েছে। তবে এই রাস্তায় বুনো ভালুক আর জাগুয়ারের খুব উৎপাত, সঙ্গে খাবার জলের খুব অভাব। তাই দুজনে আর এগোবার সাহস করলাম না ওপরে।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে পুরো তালটা ঘুরে দেখলাম। স্বচ্ছ জল, তাল’এর নীচে পাতাঝাঁঝি মত কোনও এক জলজ গাছের বিস্তার । আর পুরো সময় জুড়ে সামনের ক্যানভাসে হিমালয়ের সাথে মেঘ রোদ্দুরের খেলা। যতই দেখি ততই মনে ভরে যায়। যাত্রী মোটে সারাদিন এ গোটা কুড়িক। তাই সেই নির্জন ঘাসের গালিচায় বসে অনন্ত সে দৃশ্যর স্বাদগ্রহন করতে বেশ ভালোই লাগে।
এবার আমাদের ফেরার পালা। তিনটে দিনে হিমালয় আমাদের দুহাতে ভরিয়ে দিয়েছে। স্হানীয়দের কথায় শীতে নাকি আরো অন্যরকম রূপ…আরো বেশী মোহময়ী। অপেক্ষায় রইলাম ভবিষ্যতে কখনও সেই শীতের রূপ দর্শনের।
(শেষ)