আজ আর পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র কিংবা কোনও স্থাপত্য নয়; এই পর্বে চলুন আজ বেরিয়ে পড়ি কলকাতা থেকে মাত্র ২২০ কিলোমিটার দূরে ওড়িশার একটি সুন্দর ছোট্ট গ্রাম বাংরিপোশিতে দু’রাত কাটিয়ে পরের দিন ভোরবেলা সিমলিপাল ন্যাশনাল পার্ক। এই ২২০ কিলোমিটারের যাত্রাপথে আমরা দেখব লোধাশুলির জঙ্গল, হাতিবাড়ি এবং সুবর্ণরেখার নদীবাঁক। সেই সঙ্গে ঝিল্লি পাখিরালয়ে নানা ধরনের পাখির সমাহার দেখে আমরা পৌঁছে যাব বাংরিপোশি। বাংরিপোশি ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার ঠাকুরানি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এক অফবিট নির্জন গ্রাম। স্থানটি তার মনোরম এবং নির্মল পরিবেশের জন্য পরিচিত। এছাড়াও আছে এখানে বুরহাবালাং নদী, কোথাও পাকা রাস্তা, আবার কোথাও কাঁচা মাটির রাস্তা। সঙ্গে থাকবে ব্রাহ্মণ কুন্ড ও নেদাম ড্যাম এবং ব্রিটিশদের তৈরি রেলওয়ে ব্রিজ।
চলুন তবে… আর দেরি না করে চার দিন এবং তিন রাতের জন্য বেরিয়ে পড়ি এই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। ওড়িশার এই চার দিনের ট্যুর প্ল্যানে আমাদের সঙ্গে ছিল চারদিনের জামা কাপড়, শুকনো খাবার, এক লিটার করে দু’টো জলের বোতল এবং ওআরএস, আর কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের সঙ্গে ছিল মশা দূরে রাখার ক্রিম, বাইকের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে ইলেকট্রনিক হাওয়া দেওয়ার মেশিন, ক্যামেরা আর অবশ্যই আমার প্রিয় মোটরসাইকেল। এই তিনরাত হোটেলে থাকব বলে আর টেন্টের ঝামেলা করি নি। জঙ্গলের মধ্যে ছোট-ছোট কটেজে থাকার মজাই আলাদা। এই জায়গায় যাওয়ায় আদর্শ সময় হল অক্টোবর থেকে মে-জুন মাস। এর পরে এখানে বর্ষাকাল শুরু হয়ে যাওয়ার ফলে সিমলিপাল ফরেস্ট বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাংরিপোশি গ্রামের সৌন্দর্য থাকে দেখার মতো। আমি বলব বর্ষাকালে দু’দিনের প্ল্যান নিয়ে বাংরিপোশি যান। আর সিমলিপাল ফরেস্ট যান শীতকালে, তাহলে বছরের দু’ধরনের রূপই আপনার দেখা হয়ে যাবে।
সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠে প্রতিদিনের নিয়মিত কাজকর্ম সেরে ৬টা নাগাদ বাইক স্টার্ট দিলাম। গতকাল রাতেই বাইকের তেল ভরে নিয়েছিলাম এবং সেই সঙ্গে হাওয়া চেক করে নিয়েছিলাম। তাই আজ সকালে কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা চলে এলাম মুম্বই-কলকাতা হাইওয়ে ধরে খড়্গপুরে, যার দূরত্ব কলকাতা থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার। পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় আড়াই ঘন্টা। তাই আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি খড়্গপুরেই ব্রেকফাস্ট শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম লোধাশুলি জঙ্গল হয়ে গোপীবল্লভপুর এর উদ্দেশ্যে। লোধাশুলি জঙ্গলের ঠিক আগে বালিভাসা টোল প্লাজা পেরিয়ে ডান দিক নিয়ে চলে আসুন দুখকুন্দি এয়ার ফিল্ডে। এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। এই এয়ারফিল্ডটি ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপান এবং চীনের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের ওপর নজরদারির জন্য তৈরি করেছিল। ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক এক বছর পরে মার্কিনিরা চলে যায় এবং এই বিমানঘাঁটি ব্রিটিশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করে দিয়ে যায়। এখন এই এয়ারফিল্ডটি কলাইকুন্ডা এয়ার ফোর্সের আওতায়। তবে এয়ারফিল্ডটি পরিত্যক্ত এবং এখানে কোনও যুদ্ধাভ্যাস করা হয় না। তাই চারপাশে জঙ্গলের মাঝে এই রানওয়ে এখনও অপেক্ষা করে বোমারু বিমানের।
তারপর আশেপাশে কিছুটা সময় কাটিয়ে চলে আসুন লোধাশুলি জঙ্গল হয়ে ফেকো মোড়। সেখান থেকে বাঁ দিক ঘুরে সুবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে চলে আসুন গোপীবল্লভপুরে। এই লোধাশুলির জঙ্গল মাওবাদী এবং হাতির উপদ্রব্যের জন্য বিখ্যাত (অথবা কুখ্যাতও বলতে পারেন)। বর্তমানে মাওবাদীদের সেরকম কার্যকলাপ লক্ষ্য করা না-গেলেও মাঝেমধ্যে এই গ্রামে হাতির হানা লেগেই থাকে। মাঝেমধ্যেই এইসব জঙ্গলে থাকা হাতির দল লোকালয়ে ঢুকে আসে খাবারের জন্য এবং তারা বিঘার পর বিঘা ধান নষ্ট করে দেয়। গোপীবল্লভপুর অতিক্রম করে ধরে নিন হাতিবাড়ি রাস্তাটি। এই রাস্তার সৌন্দর্য হল এটির লাল মোরামের কাঁচা রাস্তা, যা এক প্রকার বাঁধের কাজ করে। ডান পাশ থেকে বয়ে চলা সুবর্ণরেখা নদী এবং রাস্তার দু’পাশে ছোট-ছোট বাড়ি আর তার চারপাশে সবুজ জঙ্গল… মনে হয় যেন এই রাস্তা জঙ্গল ভেদ করে চলে গিয়েছে। কিছুটা গেলেই রয়েছে আসনবনি কাঠের ব্রিজ, যা দেখার মতো।
তারপরেই আসনবনি ব্রিজ দেখে চলে আসুন হাতিবাড়ি রোড। ১১ কিলোমিটার দূরে সুবর্ণরেখা রিভারভিউ পয়েন্টে। এই পয়েন্টটি ছবি তোলার জন্য আদর্শ। এই পয়েন্টে দেখতে পাবেন সুবর্ণরেখার এক অপরূপ সৌন্দর্য—দুপাশে বিস্তীর্ণ বালির রাশি এবং মাঝে নীলনদী বয়ে যাচ্ছে তার আপন মনে। গ্রামবাসীদের নৌকা করে মাছ ধরার ভিড় আর নদীর মাঝে এবং দুপাশে পড়ে থাকা বড়-বড় পাথরের ধ্বংসাবশেষ, যা নদী আজও ধীরে-ধীরে ধ্বংস করে চলেছে। এখানে শীতকালে নানা ধরনের পাখি দেখা যায়। তারপর বাইক নিয়ে চলে আসুন ৮ কিলোমিটার দূরে ঝিল্লি পাখিরালয়। এখানে ক্যামেরায় ৭০-৩০০ লেন্স লাগিয়ে নিন, কারণ এখানে থাকা সুবিশাল ওয়াজ টাওয়ার থেকে দেখতে পাবেন নানা ধরনের পাখি: রাজহাঁস, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন মুরগি। মাছরাঙ্গা পাখি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এই পাখিরালয়ে ঢোকার সময় থেকেই আপনি দেখতে পাবেন রাস্তার দু’পাশে সুন্দর করে সাজানো ছোট-বড় গাছ এবং নানা ধরনের সুন্দর-সুন্দর ফুলের সমাহার, যা আপনার মনকে ভরিয়ে তুলবে। রয়েছে বাচ্চাদের খেলার জন্য একটি ছোট্ট পার্ক, আছে একটা বিশাল দিঘি। দিঘির চারপাশ জুড়ে সুবিশাল জঙ্গল, যা পাখিদের থাকার আদর্শ জায়গা এবং দিঘির স্বচ্ছ জলে রয়েছে পদ্ম এবং শালুক ফুলের সমাহার। আকাশের নীল রং এই দিঘিতে প্রতিফলিত হয়ে তার এক অপরুপ সৌন্দর্য গড়ে তুলেছে। এই পাখিরালয় ঘুরতে-ঘুরতে আপনার কখন যে সময় কেটে যাবে, বুঝতেই পারবেন না। ছবির মতো সুন্দর এক জায়গা, যেখানে পাবেন প্রকৃতির মধ্যে নানা রঙের সমাহার। আর এই জায়গাটি জঙ্গলের মাঝে এক বিশাল খোলা প্রান্তরের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় এখানে অনবরত মনমাতানো হাওয়া বয়ে চলে।
তারপর বাইক নিয়ে সোজা চলে আসুন সিমলিপাল খাইরি রিসোর্টে। ঝিল্লি পাখিরালয় থেকে এই রিসোর্টের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার, যেখানে পৌঁছতে আনুমানিক ৪৫ মিনিট সময় লাগবে। এখানে পাবেন জঙ্গলের মধ্যে নিরিবিলি পরিবেশ। ছোট-বড় একাধিক ঘর, যা আপনি নিজের পছন্দ মতো বেছে নিতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা হল এখানে বনফায়ার করার জায়গা আছে। সঙ্গে বার্বিকিউ… এই রিসর্টের মধ্যেই দেখা মিলবে নানা ধরনের ফুল এবং সরীসৃপ প্রাণীর। আমি দু’দিনের জন্য এই রিসোর্ট বুক করেছিলাম। এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে রাইডিং গিয়ার এবং জ্যাকেট খুলে একটু রেস্ট নিয়ে নিলাম রুমের মধ্যে। হেলমেট এবং রাইডিং গিয়ার যে কীভাবে মানুষের জীবন বাঁচায়, তা আমি ওড়িশার দারিংবাড়ি যাওয়ার অভিজ্ঞতায় দেখেছি আমাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনায়।
চলুন এবার ঘুরে আসি বাংরিপোশির বিখ্যাত বুরহাবালাং নদীর ধারে। আমাদের রিসোর্টের ঠিক উল্টোদিকে এনএইচ পেরিয়ে পাকা রাস্তা এবং পরে গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে চলে আসুন বুরহাবালাং নদীর ধারে। যা বয়ে চলেছে পাহাড়ের রূপ নিয়ে নুড়িপাথর অতিক্রম করে আঁকাবাঁকা নদী পথ দিয়ে। একটি বিকেলে নদীর তীরে বসে পাথর কুড়িয়ে আর ছবি তুলে কখন যে সন্ধ্যে হয়ে আসবে, আপনি বুঝতেই পারবেন না। নদী এবং নদীর পাশে থাকা ছোট-বড় পাথরে সূর্য অস্তের সোনালি আলো পড়ে তা অপরূপ শোভা ধারণ করেছে। এই নদীকে আরও ভালভাবে দেখার ঠিকানা হল বাদাম ঘাঁটি। স্থানীয় কয়েকজন লোক নদীর ধারে মাছ ধরছিল। আমি সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম আজকের দিনের শেষ গন্তব্যস্থলে।
ঠাকুরানি পাহাড়ে অবস্থিত দুয়ারসিনী মন্দির বনবিবি এবং কনক দুর্গা মন্দির নামেও পরিচিত। বনবিবি মন্দির এখানে বেশ জনপ্রিয়। মন্দিরটি যে স্থানে অবস্থিত, সেটিকে আসলে সিমলিপাল বনের প্রবেশদ্বার হিসেবেই ধরা হয়। একইভাবে বনবিবির আশীর্বাদ নেন স্থানীয়রা। কিছুক্ষণ আশেপাশে সময় কাটিয়ে রাস্তার উপরে থাকা এক চায়ের দোকানে খাঁটি মোষের দুধের চা খেয়ে রিসর্টে ফিরলাম। রিসর্টে এসে এখানে ঘুরতে আসা কিছু বাঙালি এবং ওড়িয়া পর্যটকের সঙ্গে কথা বলে রাতের মাংস-রুটি খেয়ে রাত দশটা নাগাদ শুয়ে পড়লাম।
আগামী পর্বে থাকছে বাংরিপোশির কিছু সাইট সিন এবং সিমলিপাল ফরেস্ট আর একটা অসাধারণ কুন্ড।