Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ১৬—প্রকৃতির মাঝে এ এক অন্য লাদাখ, চতুর্থ পর্ব

TV9 Bangla Digital | Edited By: megha

Sep 04, 2023 | 11:23 AM

Ladakh: এক-একটি জায়গার মানুষের জীবনযাত্রা, আদব-কায়দা, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের মেলবন্ধন, জীবিকা ইত্যাদির সঙ্গে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এমনকি কাশ্মীর, লে-লাদাখ কিংবা কল্পা-কিন্নর, ইত্যাদি জায়গার মানুষের গায়ের রং, তাদের গঠনে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ১৬—প্রকৃতির মাঝে এ এক অন্য লাদাখ, চতুর্থ পর্ব

Follow Us

বেলা তখন দেড়টা বাজে। আমাদের মাথার উপর দিয়ে যখন একটা SU 30 MKI। এবং তাকে পিছন থেকে অ্যাটাক করছে তিনটি Mig 29। আমাদের আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে, আমরা পাঠানকোট এসে গিয়েছি। তাদের ভয়ংকর গতি এবং আওয়াজ দেখে আমাদের মধ্যে একজন (যেহেতু সে আমার কাছে ছিল, তাই) একটু গতি কমিয়ে কাছে এসে বলেই ফেলল, “যুদ্ধ লেগেছে বুঝি।” আমি যেহেতু জানি, তাই ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলাম: যে P.A.D. চলছে, আর তারা প্রায় প্রত্যেক দিনই এসব মহড়া করে থাকে। ঠিক জম্মু-কাশ্মীর ঢোকার সময় একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তরমুজ এবং আখের রস খেলাম সবাই। খানিক বিরতির পর আবার আমাদের পথচলা শুরু। উদ্দেশ্য আমাদের একটাই: লাদাখ। খানিকটা চলার পর দেখলাম রাভি নদী। এই নদীর উপরে আমরা তাড়াতাড়ি দু’-তিনটে ছবি তুলে নিলাম। এই নদীতে এখন তেমন কোনও জল নেই, নুড়ি পাথরের মধ্য দিয়ে সরু নালার আকারে বয়ে যাচ্ছে জল। রাভি মানে ইরাবতী নদী। এই নদীটি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় চাম্বা জেলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান অতিক্রম করে। এটি একটি অন্ত সীমান্ত নদী। নদী পেরোতেই রাস্তার উপর টোল প্লাজা এসে পড়ল। মাথায় বড়-বড় করে লেখা, ‘ওয়েলকাম টু জম্বু অ্যান্ড কাশ্মীর’। মানে ভূস্বর্গে ঢুকে পড়লাম আমরা। গরম কিন্তু একই রকম… শুধু লু-এর প্রভাব।

ছবি: সঞ্জীব নস্কর

আমরা আটটা বাইক প্রায় একই সঙ্গে যাচ্ছি। আমাদের গ্রুপে সবাইকেই বলা হয়েছিল আজকের রাত উধমপুরে কাটাবো। তাই আর দেরি না করে কিছুদূর গিয়ে দেখি, সবাই দাঁড়িয়ে আছে। উধমপুর যাওয়ার ২টি রাস্তা। একটি শ্রীনগর-কন্যাকুমারী ন্যাশনাল হাইওয়ে হয়ে যাওয়া যায়। আর অন্যটি ঠিক দেঘ্ নালা পেরিয়ে এনএইচ-৪৪কে ডান দিকে রেখে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে সাম্বা-মানসার-উধমপুর রোড নামে পরিচিত, সেই রাস্তা। আমরা দ্বিতীয় রাস্তাটাই ধরলাম। জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকেই একটা প্রধান কাজ তাড়াতাড়ি সেরে ফেললাম। যেটি হল, ফোনের সিম কার্ড পরিবর্তন করা। আমরা আধার কার্ড দেখিয়ে দু’টো কোম্পানির আলাদা-আলাদা দু’টো সিম নিয়ে নিলাম। তার কারণ অন্য কোনও রাজ্যের সিমই এখানে চলবে না। এইসব করতে মোটামুটি আরও এক ঘণ্টা সময় লেগে গেল। কিছু দূরে গিয়ে আবার নালা পেরিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে গাছপালা, ঘর-বাড়ি দেখতে-দেখতে (বেলা পড়ে যাওয়ায়) ধূসর লাল আলোয় গাছের ফাঁক দিয়ে পৌঁছে গেলাম মানসার লেক। এই লেকের চারিদিক সবুজ পাহাড়ে ঘেরা। এই লেখটি নীল রং পরিবর্তন করে। এখন সূর্যের ধূসর লালচে রং ধারণ করেছে। এরপর আমরা বাইকগুলোকে পার্কিং স্পটে রেখে একে-একে প্রবেশ করলাম। অজস্র মাছের সমাবেশে অস্থির লেকের জল। সঙ্গে কচ্ছপেরও দেখা মিলল। ২০২২-এর যাত্রার সময় আমরা দু’টো টেন্ট খাটিয়ে এখানেই ছিলাম। মানসার লেকের ঠিক পাশে হাজারো তারার নিচে এ সুন্দর প্রকৃতির মাঝে আমাদের থাকার জায়গা হয়েছিল। ২০১৮-য় উধমপুরে থাকার কারণে আমরা যে, যার বাইক নিয়ে এগিয়ে চললাম। কারণ রাত হয়ে আসছে। রাতে পাহাড়ে বাইক চালানো মোটেই নিরাপদ নয়।

ছবি: সঞ্জীব নস্কর

অবশেষে সন্ধের সময় আমরা উধমপুরে এসে পৌঁছলাম। রাস্তার পাশে বিশাল এলাকা জুড়ে সেনা ছাউনি। ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সেনার কনভয়। স্থানীয় বাজার তখনও ব্যস্ত। NH44-এ ওঠার ঠিক আগের একটি গ্রামের পাহাড়ি মেয়ের দল দূরে কোনও এক টিউবওয়েল থেকে কলসি ভরে জল মাথায় করে নিয়ে বাড়ি ফিরছে। তখন তাদের কাছে টিউবওয়েলের খোঁজ করায় ওই মহিলারা জলের কলসি নামিয়ে জল খাওয়ালেন আমাদের সবাইকে। আমরা সবাই জল খেয়ে ও ভর্তি করে নিলাম বোতলে। উধমপুরে মেইন রোড ঠিক ক্রস করে গোল মার্কেটের ঠিক আগে এটিএম-এর উল্টোদিকে আমরা একে-একে দাঁড়ালাম। তার মধ্যে দু’জন দাদা দায়িত্ব নিলেন সস্তার হোটেল কোথায় পাওয়া যায়, তার। এরই ফাঁকে বেশ মজার একটা কাণ্ড ঘটে গেল। আমাদের মধ্যে একজনের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেস-এর ব্যাগটা পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তায় অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর অবশেষে আমাদের কাছেই তা পাওয়া গেল। এরই মধ্যে একজন আবার কাশ্মীরি আপেল আর নানা ফলের দিকে নিষ্পাপ শিশুর মতো তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ আমরা তা লক্ষ্য করছি। একবার ভাবলাম, আমাদের সবার কাছে তো টাকা আছে। তা ফল না কিনে তাকিয়ে আছে কেন? কাছে গিয়ে বুঝলাম, ফল নয়। আপেল বিক্রেতাকে দেখছে। সে নিজেই আবার বলে ফেলল, এখানে শ্বশুরবাড়ি করলে কি আমাদের ওখান থেকে দূরত্বটা অনেক বেশি হয়ে যাবে! গতি খারাপ দেখে ঝটপট আমরা তাকে টেনে নিয়ে এলাম। এক-একটি জায়গার মানুষের জীবনযাত্রা, আদব-কায়দা, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের মেলবন্ধন, জীবিকা ইত্যাদির সঙ্গে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এমনকি কাশ্মীর, লে-লাদাখ কিংবা কল্পা-কিন্নর, ইত্যাদি জায়গার মানুষের গায়ের রং, তাদের গঠনে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অবশেষে আমরা একটি হোটেলে উঠলাম। হোটেলে চেক-ইন করে সবাই যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে নিলাম। পরে এই হোটেলের রান্নাঘরে খিচুড়ি আর ডিমভাজা রান্না করে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে নিমেষের মধ্য়ে ঘুম এসে গেল।

ছবি: সঞ্জীব নস্কর

এখানে বলে রাখি, ২০১৮ সালের লাদাখ যাত্রায় আমরা চাল, ডাল, নুন, তেল এবং রান্না করার জন্য হাতে পাম দেওয়া স্টোভ, ম্যাগি, ড্রাই ফুড, বিস্কিট… আরও অনেক কিছু কলকাতা থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম।

২৬ শে মে… হঠাৎ অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে দেখি ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটে। আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি উঠে গাড়িতে লাগেজ বেঁধে ঘর ভাড়া বাবদ দেড় হাজার টাকা দিয়ে যখন হোটেল ছাড়লাম, তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। হোটেলের সামনে আমরা সবাই আজকের প্ল্যান নিয়ে বিশদে কথা বলছিলাম। সঙ্গে সকলের চা-বিস্কুট, আর কানের পাশ দিয়ে বয়ে-চলা ঠান্ডা হওয়া বেশ ভালই লাগছিল। কিছু পরে বাইক স্টার্ট দিয়ে সামরোলি থেকে চেনানি এসে পৌঁছলাম। আমাদের ডান পাশ থেকে বয়ে চলছে তাবি নদী। রাস্তার কাজ হওয়ার ফলে এই ৩০ কিলোমিটার রাস্তায় পৌঁছতে আমাদের সময় লেগে গেল প্রায় দেড় ঘণ্টা। তাই কোনওমতে মাথা ঠান্ডা রেখে সেনার কনভয়কে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লাম চেনানি-নাসরি-টানেলে। এই ৯.২ কিমি দীর্ঘ টানেল চেনানি শহর থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে এবং জম্বু থেকে শ্রীনগরের দূরত্ব অনেকটা কমিয়ে দেয়। এই রাস্তা পাটনিটোপে শীতকালে তুষারপাত এবং পুরানো এনএইচ-ওয়ানের ট্রাফিক জ্যাম কমাতে সাহায্য করে। আধুনিক এই টানেলের ভিতরের অভিজ্ঞতা অসাধারণ। এই দীর্ঘ সুড়ঙ্গের ভিতরটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগত। আবহাওয়ার সঙ্গে গাড়ি এবং আমাদের আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার… সব মিলিয়ে যেন একটা কৃত্রিম পরিবেশের সঙ্গে সিসিটিভির নজরদারি, এককথায় অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা। টানেলটা অতিক্রম করে মনে হল এ এক অন্য পৃথিবী।

ছবি: সঞ্জীব নস্কর

টানেল পেরিয়ে কিছুদুর গিয়ে একটা পেট্রল পাম্প দেখে আমরা তেল এবং হাওয়া চেক করে নিলাম। এর সঙ্গে আমরা আমাদের সকালের খাবারও খেয়ে নিলাম। ডান পাশ দিয়ে পাহাড়ের একেবারে নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরোস্রতা চন্দ্রভাগা নদী। আমরা এখন বাগলিহার ড্যাম-এর ঠিক কাছে। চন্দ্রভাগা নদীটি বারালাচ লা পাশের বিপুল হিমবাহের গলনের ফলে তৈরি। বারালাচ লা পাশের দক্ষিণ দিক থেকে যে নদী প্রবাহিত হয়, তার নাম চন্দ্র আর উত্তর দিকের নদীর নাম ভাগা। ২টি নদী টান্ডি, শিলংয়ের কাছে মিলিত হয়ে চন্দ্রভাগা বা চেনাব নামে পরিচিত। এরপর আমরা বানিহালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। বাগলিহার হাইড্রো ইলেক্ট্রিক প্রজেক্টকে ডানপাশে ফেলে এগিয়ে চললাম তাংয়ের উদ্দেশ্যে।

…. হঠাৎ ডান পাশ দিয়ে আসা গাড়িটা ওভারটেক করে স্পিড কমিয়ে বলল, “ঝাণ্ডা উতার দে, ইয়ে কাশ্মীর হে, আপকা ভারত নহি… ইয়ে ছোটা পাকিস্তান।”

Next Article