Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ২০—পুলিশ-আর্মি ক্যাম্প নিয়ে সুন্দর গ্রাম জনপদ তাংসে, অষ্টম পর্ব

TV9 Bangla Digital | Edited By: megha

Oct 02, 2023 | 10:51 AM

Ladakh Trip: প্রায় সাড়ে আট'টা নাগাদ রওনা দিলাম খারদুংলার উদ্দেশ্যে। আকাশ এক্কেবারে ঝকঝকে। লেহ-এর উত্তরে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটারের চড়াইয়ে অবস্থিত পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম মোটরেবল পাস খারদুংলা। উচ্চতা উনিশ হাজার তিনশো আশি ফুট। এই চল্লিশ কিলোমিটারেই প্রায় আট হাজার ফুটের এলিভেশন।

Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ২০—পুলিশ-আর্মি ক্যাম্প নিয়ে সুন্দর গ্রাম জনপদ তাংসে, অষ্টম পর্ব
ট্রাভেল স্টোরি

Follow Us

৩০শে মে

প্রায় সাড়ে আট’টা নাগাদ রওনা দিলাম খারদুংলার উদ্দেশ্যে। আকাশ এক্কেবারে ঝকঝকে। লেহ-এর উত্তরে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটারের চড়াইয়ে অবস্থিত পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম মোটরেবল পাস খারদুংলা। উচ্চতা উনিশ হাজার তিনশো আশি ফুট। এই চল্লিশ কিলোমিটারেই প্রায় আট হাজার ফুটের এলিভেশন।

প্রায় সাড়ে এগারোটায় যখন খারদুং’লা টপে পৌঁছালাম, দেখলাম চারিদিকের নিস্তব্ধতা এক নিমেষে কাটিয়ে একটা ছোটখাটো মেলার আকার নিয়েছে জায়গাটা। অভিযাত্রীদের নিঃশ্বাসের গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে, বরফগলা পরিস্থিতি। সে দলে অবশ্য আমরাও বাদ পড়ি না। চড়াইপথের শেষ বাঁকের পরেই কিছুটা চওড়া জায়গা। রাস্তার দু’দিক থেকে উঠেছে বরফের টিলা। টিলার একেবারে ওপরে খারদুং লা গুম্ফা। একটা আইস স্তূপাও রয়েছে পাশেই। রয়েছে আর্মি ক্যাম্প। রাস্তার ধারের সেই বহু প্রতীক্ষিত উজ্জ্বল হলুদ রঙা মাইলফলকের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম আমরা। ভিড়ের চোটে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল ছবি তোলার সুযোগ পেতে। আনন্দ-উত্তেজনায় সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা বুঝতেই পারলাম না। হঠাৎই আবহাওয়া খারাপ হয়ে এল। ঠান্ডা হাওয়ার দমকায় মেঘ উড়িয়ে আকাশ ঢেকে দিল মুহুর্তেই। মেঘ-কুয়াশার অট্টহাসিতে মুক্তোর মতো তুষার ঝরে পড়তে শুরু করেছে। ঠান্ডা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সকলেরই অল্প-বেশি মাথা যন্ত্রণা আর বমিভাব অশনি সংকেত দিচ্ছে ক্রমাগত। তাই স্নো’ফল উপভোগ না করেই তাড়াতাড়ি নীচে নামা শুরু করলাম। ঠিক হল, নর্থ পুল্লু পৌঁছে পেটে কিছু দেওয়াটা এবেলা খুব প্রয়োজন। কিন্তু নীচে নামার বেগ বারবার প্রতিহত করে চলেছে দু’পাশের দুধসাদা বরফ-সাম্রাজ্য। প্রকৃতির এমন রূপ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এমন দৃশ্য গোছা-গোছা ক্যামেরাবন্দি করে নেমে এলাম নর্থ পুল্লু। নীচের দিকে নামতে-নামতেই আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া এবং বিরতি শেষ করে আমরা ছুটলাম নুব্রার উদ্দেশ্যে। ওপারের পাহাড়ে মেঘ-রোদের আঁকিবুকি চলছে প্রতিনিয়ত। অপরূপ তার রূপ! ঠিক কুড়ি কিলোমিটার পরে ডান-বাঁ’য়ে দু’টো রাস্তা ভাগ হয়েছে। একটা চলে গিয়েছে সায়ক, দুরবুক, তাংসে হয়ে পাংগং-এর দিকে। আর একটা নিয়ে যাচ্ছে আমাদের গন্তব্য, ডিস্কিট হয়ে হুন্ডারে। এইপথেই খালসার পেরিয়ে নদীর কাছাকছি এসে দাঁড়ালাম। খালসার থেকে আর একটা রাস্তাও অবশ্য গিয়েছে হুন্ডার হয়ে তুরতুক পর্যন্ত। নদীর পাড়ের এই বাইপাস রাস্তা ডিস্কিটে গিয়ে ওই রাস্তায় মিশেছে।

তিন চার কিলোমিটারের মসৃণ ঢালু পথ বেয়ে পৌঁছলাম আর এক দ্বিখন্ডিত রাস্তায়। আমাদের গন্তব্যের উল্টোদিকের পথটা চলে গিয়েছে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের উদ্দেশ্যে। তিনমাথার মোড়েই একটা পরিপাটি করে সাজানো ধাবা। চা খাওয়ার ফাঁকে ভালভাবে রেইকি করে নেওয়া হল আজকের রাত কাটানোর স্থান-কাল-পাত্র। ধাবার পিছনেই বেশ বড়, একেবারে সমান্তরাল পাথুরে জমি, পাশেই ঝোপঝাড়, তারপরেই নদী। টেন্টিং-এর জন্য আর্দশ গ্রাউন্ড বলতে যা বুঝি। ধাবার ভাই আর আর্মিদের সঙ্গে কথা বলে রাতের নিরাপত্তার ব্যাপারে সুনিশ্চিত হয়ে ডিস্কিটের দিকে এগোলাম। এরোপ্লেনের রানওয়ের মতো টানা রাস্তায় কিছুটা বাইক চালানোর পর আবার চড়াই শুরু হল। নিচের বালিয়াড়ির মাছের আঁশের মতো নিঃশ্চল ঢেউগুলো হাওয়ায়-হাওয়ায় আছড়ে পড়ছে একে-অপরের গায়ে, বদলে যাচ্ছে প্রেক্ষাপট। ঠিক যেমন স্যান্ড আর্টিস্ট আঙুলের খেলায় নিমেষে বদলে ফেলে ক্যানভাস। রোদের আলো পড়ে দূরের বিস্তীর্ণ মরীচিকা চিকচিক করছে। এসব চাক্ষুস করতে-করতে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই পৌঁছে গেলাম শীতল মরুভূমি হুন্ডার।

নুব্রা ভ্যালি জুড়ে সাদা বালির মরুভূমি। তারই মাঝে নালার আকারে নদী কিছু-কিছু অংশে সবুজের আমদানি করেছে। গ্রাম আর হোটেল-হোম স্টে থেকে আরও একটু এগিয়ে গেলে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় মেন ট্যুরিস্ট স্পট। মধ্য এশিয়া ছাড়া ভারতের দু’কুঁজওয়ালা উট বা ডবল হাম্পড ব‍্যাক্ট্রিয়ান ক্যামেল একমাত্র এখানেই পাওয়া যায়। অতীতে সিল্ক রুটের বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম হিসেবে এই উঠের ব্যবহার হত। সময়ের সঙ্গে যা এখন শুধুমাত্র পর্যটক মনোরঞ্জনের উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২২-এর লাদাখযাত্রায় আমরা এখানেই তাঁবুতে রাত কাটিয়েছিলাম, তার সঙ্গে একটি হিন্দু হোটেলের রুই মাছের ঝোল আর ভাত খেয়েছিলাম এখানেই।

সন্ধ্যা নেমে এল বলে। তুরতুক যাওয়ার প্ল্যান ক্যান্সেল করে ফেরার পথ ধরলাম। ডিস্কিট গ্রামের ঠিক উপরেই ডিস্কিট মনেস্ট্রির সঙ্গেই সুবিশাল বৌদ্ধমূর্তি দেখতে উঠতে হল আরও কিছুটা। রাজরূপে ভগবান বুদ্ধের মূর্তি, মোহিত করে রেখেছে চারিপাশটাকে। নেমে এলাম আমাদের আস্তানায়। তাঁবু খাটানোর সঙ্গে সঙ্গেই সন্ধে এসে হাজির হল। ধাবার লোকজন সারাদিনের ব্যবসা সেরে ফিরে গিয়েছে যে-যার গ্রামে। সবাই হাতাহাতি করে চাল-ডাল ধুয়ে, সব্জি কেটে খিচুড়ি চাপানো হল প্রেসার কুকারে। সন্ধ্যার পরেই অন্ধকার যেমন চারিদিকটাকে অপরিচিত করে তুলেছিল, তেমনিই রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা আকাশ আলো করে দিগ্বিদিক জ্যোৎস্নায় ভাসিয়ে চাঁদ উঠেছিল গগনে। রান্না শেষ হলে আগুন নিভিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন টেন্টে ঢুকলাম, ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা। টেম্পারেচার মাইনাসে নেমেছে। কনকনে হাওয়া জ্যাকেট যেন স্লিপিং ব্যাগ ফুঁড়ে ঢুকে পড়ছে। ভোর হতে না হতেই উঠে পড়ল সকলে।

একত্রিশ তারিখ
ঘুম থেকে উঠেই প্রকৃতির এতবড় খোলা ক্যানভাসে ওয়েট টিস্যু পেপার হাতে যে যার মতো শিল্পকার্য শেষ করে ম্যাগি আর কফি সহযোগে টিফিন সেরে বেরিয়ে পড়লাম। একশো সত্তর কিমির পথে আজকের গন্তব্য প্যাংগং সো (লেক)। খালসার পেরিয়ে খাড়াই পাহাড়ের গা বেয়ে সরু রাস্তা ধরে কিছুটা যাওয়ার পরই দু’-তিন বাঁক ঘুরে নেমে এলাম একেবারে নদীর ভিতর। এখান থেকে নদীপথেই যেতে হবে সায়ক (Shyok) গ্রাম পর্যন্ত। স্রোতের প্রবাহ মধ্যমবর্গীয়। খালসার থেকে সায়ক ভিলেজ প্রায় নব্বই কিলোমিটারের পথ। রাস্তা বেশিরভাগটাই নেই। গাড়ির চাকার চাপে নুড়ি পাথর বসে গিয়ে নদীর মধ্যেই রাস্তার আকার নিয়েছে। রয়েছে দু’-একটা ছোটখাটো ওয়াটার ক্রসিং। দুপুরের আগেই সায়ক গ্রাম পেরিয়ে দুরবুক এসে পৌঁছলাম। লেহ থেকে চাং’লা হয়ে আর একটা রাস্তা আমাদের উল্টোদিক থেকে দুরবুকে এসে পৌঁছেছে। সায়ক থেকে দুরবুকের রাস্তা কিন্তু বেশ খাড়াই উৎরাই। জংশনের এক লাঞ্চ পয়েন্টে রাজমা-চাওল আর রুটি-মিক্সড ভেজ ভাগাভাগি করে নিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। গরম-গরম খাবারের আশায় একটু দেরি হয়ে গেল। প্রায় দু’টো নাগাদ বেরোলাম আমরা। দুরবুকের পরের ছোট জনপদ তাংসে। ছোট-ছোট কয়েক ঘরের বাস। হোম স্টে, হোটেল, রিসর্ট আর পুলিশ-আর্মি ক্যাম্প নিয়ে বেশ সুন্দর গ্রাম।

ঢোকার মুখেই চেকপোস্টে নির্দিষ্ট কাগজপত্র দেখিয়ে পাংগং-এর দিকে পা বাড়ালাম। একে-অপরের সঙ্গে কথা বলে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে কখন তাংসে পেরিয়ে চাংথ্যাং কোল্ড ডেজার্ট ওয়াইল্ড লাইফ জোনে এসে পৌঁছলাম, বুঝতেই পারিনি। মিশকালো পিচ রাস্তার দুপাশে স্যাঁতস্যাঁতে সবুজ ওয়েটল্যান্ড, কখনও বা সাদা বালির সমতলভুমি। এ দিকে-ও দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জংলি ঘোড়ার দল। সাদা-সাদা পাখির ঝাঁক কোথাও-কোথাও দলবেঁধে হল্লা করছে। কাছেই ইয়াকের পরিবার মন দিয়ে ঘাস খাচ্ছে। লাদাখের এই অঞ্চলে সিনেমার শুটিং হয়ে আসছে বিগত কয়েক বছর ধরে। শাহরুখ খান অভিনীত ‘যব তক হ্যায় জান’-এর শুটিং স্পটটা বেশ বড় করে লেখা আছে দেখলাম। এরপর আরও মাইল চারেকের পথ গিয়ে প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের পর কষ্টটা একেবারে মিলিয়ে গেল। আর প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলাম প্যাংগং-এর প্রথম ঝলক। দূর থেকে হলেও এক্সাইটমেন্ট বেড়ে গেল এক ঝটকায়। পনেরো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমরা।

বিকেলের সূর্য আজকের মতো ছুটির ঘণ্টা বাজার অপেক্ষায়। গোধূলি আলোয় মায়াবী প্যাংগং বিস্ময়ে দু’চোখ স্থির করে দেয়। সবার দেখাদেখি জলে নেমে ছবি তুলতে গিয়ে গামবুটের ভেতর জল ঢুকিয়ে ফেললাম। কনকনে ঠাণ্ডা জল পায়ে যেন হাজার কাঁটা ফুটিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি উঠে আর একটু দূরে গিয়ে স্থানীয় লোকের অনুমতি আর তাঁবুপিছু দু’শো টাকার বিনিময়ে লেকের ধারে তাঁবু খাটানো হল। পরিষেবা হিসাবে পেলাম খাওয়ার জল আর ওয়াশরুম ব্যবহারের সুযোগ। ভারতের উচ্চতম লেকের পাড়ে পিন্দারে পলাশের বনের তালেতালে আমাদের সকলের নাচে সন্ধে নেমে এল। বাংলা গান শুনে রানাঘাট থেকে আসা এক বাঙালি পরিবার এসে আলাপ জমালো। রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে হাওয়ার দাপট শুরু হয়েছে। নিয়ে এসেছে অসহ্য ঠান্ডা। তার ওপর এই অলটিচিউডে নাচানাচির ফলে মাথার যন্ত্রণা। রাতে অক্সিজেন লেভেল কমে যায়। ফলে স্টোভ জ্বালানোর এক ঘণ্টা পরও প্রেসার কুকারে প্রেসার তৈরি হচ্ছিল না। আরও আধ ঘণ্টার পর কোনওক্রমে হাফসিদ্ধ খিচুড়ি খেয়ে রাতের ক্ষুধা নিবারণ করা হল। বাইরে তখন ফুলমুন নাইট। লেকের জল হাওয়ার তালে ছলাক-ছলাক সুর তুলেছে। জ্যোৎস্নার ডাকে জলে নেমে এসেছে কোটি-কোটি তারা। আজ সারা রাতের আসর বসেছে বুঝি। কল্পনায় স্বর্গের ছবি বোধহয় এরকমই হয়। ঠান্ডায় বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। স্বর্গের হাতছানি ফেলে শুয়ে পড়লাম।
সমুদ্রপৃষ্ঠের চার হাজার পাঁচশো ত্রিশ ফুট উচ্চতায় হিমালয়ের বুকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ নোনা জলের এই লেক। লম্বায় একশো পঁয়ত্রিশ কিমি আর চওড়া সর্বত পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত। এই একশো পঁয়ত্রিশ কিমির মধ্যে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার ভারতে এবং বাকি অংশ চিন অধিকৃত তিব্বতে অবস্থিত।

… ক্রমশ

Next Article