পাং ছেড়েছি ঘণ্টাখানেকের বেশি হবে। লাচুঙ লা’র চড়াই শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। রাস্তা মোটেও সুখকর নয়। তাই ইঞ্জিনের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ না করেই এগিয়ে চলেছি ধীরে-সুস্থে। কুড়ি কিমির বেশি এই পথ, পুরোটাই খারাপ আর খাড়াই রাস্তা। মাঝেমধ্যে বরফগলা জলের পিচ্ছিল কাদা। তাই ঘণ্টা দেড়েক তো লেগেই গেল লাচুং লা’য় পৌঁছতে।
এর পরের রাস্তায় একটু উন্নতি হলেও, হুইস্কি নালা পেরোতে-পেরোতেই সময় লেগে গেল আরও এক ঘণ্টা। শেষের দিকে একটুকু অংশ বাদ দিলে, হুইস্কি নালা থেকে নাকি লা’র রাস্তা মোটের ওপর বেশ। নাকি’লার উচ্চতা পনেরো হাজার পাঁচশো সাতচল্লিশ ফুট। এখান থেকে চারপাশের পাহাড়ের আকার অদ্ভুত সুন্দর। দু’টো পাশকেই উপর থেকে দেখা যায়। মনে হয় একটা পাহাড় অতিক্রম করে আর একটা পাহাড় অতিক্রম করছি। এখান থেকে নীচে নামার পথে গাটা লুপস্-এর একুশ বাঁকের উৎরাইয়ের রোলার কোস্টার রাইড বাইকারদের সন্তুষ্ট করবেই। সিকিমের সিল্ক রোড থেকেও এর বাঁক স্পষ্ট।
ঢালে নেমে এসে পৌঁছলাম সারচু। বিস্তৃত সমতলের চারপাশ পাহাড় ঘেরা। তারই একটি ছোট্ট অংশে অস্থায়ী জনপদ, ছোট-বড় কয়েকটা ধাবা, ম্যাগি পয়েন্ট—এই নিয়েই সারচু। ২০২২-এর লাদাখযাত্রায় আমরা এখানেই রাত কাটিয়েছিলাম একটি হোটেলে। খানিক এগোলে চেকপোস্ট পেরিয়ে অবশ্য দেখা মিলবে সুদৃশ্য সুইস টেন্ট ভিলাগুলোর। সারি-সারি টেন্ট সেজেগুজে তৈরি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে। রাস্তার ডানদিকে রয়েছে একটি সেনা হাসপাতাল। প্রয়োজনে সাহায্য পেতে পারেন সিভিলিয়ানরাও।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেহগামী ট্যুরিস্টদের ঢল নেমেছে যেন রাস্তা জুড়ে। বাইকিং ব্রো’কোডের নানা ভঙ্গিমায় হাত দেখিয়ে চিরাচরিত গর্জনে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে বুলেট বাহিনী। সারচু পেরিয়েছি বেশ খানিকক্ষণ হয়ে গেছে। অল্প চড়াইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে খারাপ রাস্তা। এমনিতেই পাথুরে রাস্তায় বরফগলা জলের দৌরাত্ম্য, তার ওপর কেবল (cable line) বিছানোর কাজ চলায়, আরও-আরও প্যাচপ্যাচে করে তুলেছে যাত্রাপথ। খারাপ রাস্তায় অত্যধিক ঝাঁকুনি আর বরফ-কাদা মেশানো রাস্তা দিয়ে কোনওক্রমে পৌঁছে গেলাম বারালাচা লা’পাসে।
এই করে-কের বারালাচা লা’য় যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে দুপুর গড়িয়েছে। মাথার ওপর সূর্য বরফে পড়ে চোখ ঝলসে দিচ্ছে। পুরো জার্নি জুড়ে একসঙ্গে এত বরফ দেখার সৌভাগ্য হল, শেষমেষ বারালাচা লা’য় এসে। চার হাজার আটশো নব্বই মিটারি পাস-এর ওপর থেকে বরফের মোটা চাদরে ঢাকা চারপাশের পাহাড়ের চূড়াগুলো প্রায় সমতল মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তোলা সেরে নিচের দিকে চাকা গড়ালাম। পাসের ঠিক আগেই রাস্তা তার মিশকালো পিচ রূপ ফিরে পেয়েছে, তার ওপর দু’দিকের বরফের উঁচু দেওয়াল, রাইডিংয়ের আনন্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। আর সবচেয়ে বড় কথা এখানকার বরফ এতটাই সাদা, তা আগে কোথাও দেখা যায়নি। কিছুটা যাওয়ার পরে আমরা এসে পড়লাম একটি লেকের সামনে, যার নাম সুরাজ তাল।
একতালে তাল মিলিয়ে কাছাকাছি আটটা বাইকের এঁকে-বেঁকে নেমে আসা উপভোগ করতে-করতে পৌঁছে গেলাম জিং জিং বার। একটা ছোট্ট ডিজেল পাম্প, গোটা দুই চায়ের টাপরি আর কর্মীদের অস্থায়ী টেন্ট পেরিয়েই থমকে গেলাম সকলে। সামনে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইক, চারচাকা। “আগে জানে কা রাস্তা টুট গয়া……”, চেঁচিয়ে বললেন এক ট্রাকচালক। বেলা বাড়ায় বরফগলা জলের তোড়ে রাস্তা ভেঙে এই বিপত্তি। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গীন যে, এতটা পথ এসেও অনেকে সারচু ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের এগোতেই হবে। তাই আর দেরি না করে কোনও মতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে চললাম। জলের স্রোত শুরু হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল। ছিপছিপে জল, পিচের ওপর হালকা স্রোতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে অজানা আতঙ্কের দিকে। তখন জলের তোড়ে ভেঙে যাওয়া অংশে এসে পৌঁছয়নি। চোখের সামনে পিচের রাস্তায় হটাৎ ফাটল ধরতে দেখলাম। বুঝলাম দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই স্থান পরিত্যাগ না করলে আর রক্ষে নেই। স্রোতের কাছে এসে দাঁড়ালাম আমরা। ওপর থেকে জলের তোড়ে পাথর নেমে আসছে একটা-দু’টো করে। জলের স্তর বেড়ে হাঁটু পেরিয়েছে। দুশ্চিন্তা যখন কপালে ভাঁজ ফেলেছে, এমন সময় আমাদেরই একজন স্পিলেন্ডার নিয়ে পা দু’টো অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ওপরের দিকে তুলে স্রোতে নৌকো চালানোর মতো করে প্রায় ষাট-সত্তর ফুট নালা পেরিয়ে গেল এক নিমেষে। বাইকের সিট প্রায় ডুবে যায়-যায়। তবে এই দেখে মনে বল পেলাম। বাহন থামিয়ে একে-অপরের বাইক ঠেলেঠুলে কোনও মতে পেরিয়ে এলাম জায়গাটা। উরু-ডোবা কনকনে ঠান্ডা জল গোটা শরীরে কাঁপুনি ধরিয়েছে। বিপদ পার করে আরও কিছুটা এগিয়ে নিশ্চিন্তে কেলঙের রাস্তা ধরলাম। মানালি যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আজ আর উপায় ছিলোনা। একে সন্ধ্যে হয়ে আসছে, ঠিক হল সামনের সিসুতেই আজ রাতের ডেরা জমাবো। তেল ভরা সেরে সিসু’র এক হোম স্টে-তে মাথাগোঁজার ব্যবস্থা করা হল।
সকালে উঠে কাকভোরে বেরিয়ে পড়লাম। কালকের বৃষ্টিভেজা রাস্তায় বেশ কয়েক জায়গায় ল্যান্ডস্লাইড আর কাদা জল পেরিয়ে কোকসারে ব্রেকফাস্ট সারলাম। কোকসারের আগে অটল টানেলের কাজ চলছে পুরোদমে। এই টানেলটা চালু হলে মানালি-লেহ যাতায়াত সহজতর হবে রোটাংকে বাইপাস করে। কোকসার থেকে খানিক এগোলে পথে গ্রামফু পড়ে। এইখান থেকেই রাস্তা চলে গিয়েছে স্পিতি ভ্যালির উদ্দেশ্যে। তবে আমরা এগিয়ে চললাম এনএইচওয়ান ধরে, মানালির দিকে।
এতোদিনের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা ধীরে-ধীরে শেষ হতে শুরু করেছে। তার আভাস পেলাম রোটাং-এ ওঠার মুহূর্ত থেকেই। রোটাং পাসে ট্যুরিস্টদের ভিড়ে পাহাড় যেন বড্ড একা হয়ে গিয়েছে, সূর্যের আলোয় এখানকার মলিন বরফ সেরকম ভাবে ঝলসে ওঠে না। ইদানীং অপরিকল্পিত বাণিজ্যিককরণ কেড়ে নিয়েছে প্রকৃতির সরল সৌন্দর্য্য।
রোটাং-এ বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আঁকাবাঁকা পথে নামতে শুরু করলাম। চারিদিকে কোহরা হি কোহরা…. নাম মাত্র দৃশ্যমানতা। তারই ফাঁকে রঙ-বেরঙের পাখনা উড়িয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে প্যারাগ্লাইডারের দল। মন খারাপের কুয়াশায় পাহাড়ের কোল ভরিয়েছে। বরফচূড়া, রাস্তার বরফ দেওয়াল, পথের পাশে বরফের জমি, সেই জমিতে হাতে বানানো বরফের গোলা… সব পিছনে ফেলে লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে, শেষ মুহূর্তটুকু চোখে না হারানোর বিফল একটা চেষ্টা নিয়ে মানালির ভিড়ে নিজেদের সঁপে দিলাম। এবার যে ঘরে ফেরার পালা।
হিমালয় পর্বতমালায় প্রবেশ করে প্রকৃতি আবারও সবুজ হয়ে উঠেছে। তাই প্রায় সারাদিন বাইক চালিয়ে সন্ধের দিকে পৌঁছে গেলাম আম্বালা। তারপরের দিন আম্বালা থেকে লখনউ। লখনউ থেকে দভি। দভি থেকে কলকাতা। প্রায় একুশশো কিলোমিটার রাস্তা, দশজনের একটা টিম আর এই মোটরসাইকেল।
… সমাপ্ত