শোভাবাজার রাজবাটী। কলকাতার ইতিহাস লিখতে বসলে যাঁদের কথা না বললে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কেবল ইতিহাস নয়, বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসেও শোভাবাজার রাজবাড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য। যাত্রা, নাট্যজগত, কবিগানের লড়াই, বাঈজি নাচ, সঙ্গীত সব ক্ষেত্রেই গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকের চরিত্রে দেখা গিয়েছে শোভাবাজারের দেব পরিবারকে। যে সময় সমাজের পণ্ডিত এবং শাস্ত্রজ্ঞদের খাঁড়া মাইকেল মধুসূদন দত্তের উপরে নেমে এসেছিল, ঠিক সেই সময়ে তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ অভিনীত হয়েছিল এই শোভাবাজার রাজবাড়িরই এক অংশে।
এমনকি, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও সেই ধারায় কোনও ছেদ পড়েনি। কয়েক বছর আগেই কলকাতায় নাট্যজগতে আলোড়ন তুলেছিল ‘থিয়েলাইট’ নাট্যদল প্রযোজিত ‘মেম সাহেবের ঘড়ি’। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘হাবু ভুঁইমালির পুতুল’ গল্প অবলম্বনে এই বিশেষ নাটক কলকাতা তথা বাংলায় অভিনীত হওয়া প্রথম ৩৬০ ডিগ্রি সাইড স্পেসিফিক থিয়েটার। আর বাংলা থিয়েটারের এই পদক্ষেপেও পাশে ছিল শোভাবাজার রাজবাড়ি। শোভাবাজার রাজবাড়ির উঠোন থেকে ঠাকুর দালান গোটা বাড়ি জুড়ে চলে অভিনয়।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দী, সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে আজও নাম জড়িয়ে দেব পরিবারের। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে শোভাবাজার রাজবাড়ির পরিচিতি দুর্গাপুজোকে ঘিরেই। এখনও প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন রাজবাড়ির ঠাকুরদালানের সামনে। শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তাঁর হাত ধরেই, ১৭৫৭ সালে শুরু দুর্গাপুজোর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুন্সী থেকে, শোভাবাজারের রাজা হয়ে ওঠা। কেবল রাজা নয়, সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব ও তাঁর বংশধরেরা। আবার আমোদপ্রমোদ উৎসব আয়োজনের দিক থেকেও কম যায় না দেব পরিবার। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণও এই দুর্গাপুজোই।
শোভাবাজার রাজবাড়িতে যখন দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল, তখন গোটা বাংলায় হাতে গোনা কয়েক জায়গায় দুর্গাপুজোর চল ছিল। তখন দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এত আড়ম্বর ছিল না। তবে ব্যতিক্রম নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এবং বর্তমানের দক্ষিণ কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়ির পুজো। এঁরা মাতৃ আরাধনার সূচনা করেন যথাক্রমে ১৬০১ সালে ও ১৬১০ সালে। কিন্তু কলকাতায় দুর্গাপুজোর শুরু রাজা নবকৃষ্ণের হাতেই। আর সেই পুজোর জাঁকজমকও ছাপিয়ে গিয়েছিল বাকি সকলকেই।
সর্বত্র পুজো শুরু হয় ষষ্ঠীর সকালে বোধন দিয়ে। তবে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো শুরু হয় মহালয়ারও আগে, কৃষ্ণা নবমীর বিকেলে। এই দিন রীতিনীতি মেনে চন্ডী মণ্ডপ স্থাপন এবং মা দুর্গার আগমন-কে কেন্দ্র করে কৃষ্ণানবম্যাদি কল্পারম্ভ ও বোধনের পুজো শুরু হয়। প্রথা মেনে প্রধান পুরোহিত প্রথমে বোধনের ঘট স্থাপন করেন। তারপর ব্রতিরা প্রতিদিন সকালে ঠাকুরদালানের খিলানে খিলানে বসে মধুসূদন পাঠ, বগলা পাঠ, রামায়ণ পাঠ, চন্ডী পাঠ, দুর্গা নাম জপ করেন ষষ্ঠীর সকাল অবধি। প্রধান পুরোহিত কৃষ্ণা নবমী থেকে দু’বেলা প্রথমে এই বোধনের পুজো আরতি করবেন তারপর ষষ্ঠী থেকে দেবীর মূর্তি পুজো হবে, এই হল প্রথা। বাড়ির গৃহদেবতা গোপীনাথ জীউ ও রাধারাণী। এই সময়ে দোতলার ঘর থেকে তাঁরা তদারকি করেন যাতে বাড়ির মেয়ে দুর্গার বাপের বাড়িতে অভ্যর্থনায় কোনও ত্রুটি না থাকে। এই প্রথা অবশ্য আজও ঐতিহ্যের সঙ্গে অটুট রেখেছে রাজপরিবার।
পুজোর রীতিনীতি যেমন অন্যান্যদের থেকে আলাদা, তেমনই পুজোকে ঘিরে উৎসব দেখার মতো। শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে ইংরেজরাও। সেই সময়ে তাঁদের আমোদপ্রমোদের জন্য থাকত এলাহী আয়োজন। সারারাত লোকজনে জমজমাট তোষাখানা, নহবতখানা থেকে ঠাকুরদালান। আধঘুমন্ত অন্ধকার রাতে একা জ্বলজ্বল করত বাড়িটা। নানা রঙের বেলোয়াড়ি ঝাড়বাতি থেকে ঠিকরে বেড়িয়ে আসত আলো। যদিও বিধর্মীয় ইংরেজদের ঠাকুরদালানে প্রবেশ করতে দেননি হিন্দু সমাজের অন্যতম ধারক ও বাহক রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তাই রাতারাতি তাঁদের জন্য ঠাকুরদালানের উলটোদিকেই তৈরি হয় নাটমন্দির। রাজবাড়ির সেই নাটমহল সারারাত লোকে লোকারণ্য থাকত। পানপাত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করত বেয়ারারা। মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত দাদরা, কাহারওয়া, ত্রিতালের সঙ্গে ঘুঙুরের শব্দ। শ্বেত পাথরের মেঝেয় ছবি এঁকে দিত আলতা পরা পদযুগল। বিদেশী অতিথিদের জন্য উইলিয়ামস আর মেসার্স গান্টার অ্যান্ড হুপার-এর দোকান থেকে আসত নানা রকমের মাংস। হরেক রকমের মাংস রাঁধতে আসত মুসলিম, পর্তুগীজ খানসামারা। মুরগি, পাঁঠা থেকে টার্কির মাংস, পদের তালিকায় আছে সবই।
লর্ড কার্জন, বড়লাট বেন্টিঙ্ক থেকে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছোট বড় আধিকারিকদের আনাগোনা ছিল শোভাবাজারের দুর্গাপুজোয়। তাঁদের মনোরঞ্জন করতে ডাক পড়ত দেশের নামকরা বাঈজিদের। বেগম জান, গহর জান, মলিকা জান এবং আরও অনেকে এসেছেন। এক একেক জন বাঈজিকে সেই সময়ে এক রাতের জন্য দেওয়া হত দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দক্ষিণা। এঁদের মধ্যেও আবার নিকি বাঈজির বিশেষ নাম ছিল। তিনি নাকি এতই সুকন্ঠী ছিলেন যে, তাঁকে ইটালীয় অপেরা গায়িকাদের সঙ্গেও তুলনা করা হত। পাশাপাশি তাঁর রূপেরও ভক্ত ছিলেন ইংরেজরা। এমনকি ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে সুপনজান, আশরুন, হিঙ্গুল, মিশ্রি, নুরবক্স-এর মতো বাঈজিদেরও মুজরো করে যাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়।
শোনা যায় একবার লর্ড বেন্টিঙ্ক এবং তাঁর স্ত্রী এক সঙ্গে এই বাড়ির পুজোয় আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। সেই সময় তাঁরা উপস্থিত হলে শিবকৃষ্ণ দেব ও কালীকৃষ্ণ দেবের নির্দেশে বাজানো হয়েছিল ‘গড সেভ দ্য কিং’। এরপর সোনার সিংহাসনে বসতে দেওয়া হয় তাঁদের। আয়োজন করা হয়েছিল বাঈজি নাচের। নাচ শুরু হওয়ার আগে মেঝেতে ছড়িয়ে দেওয়া হল লাল, নীল, হলুদ নানা ধরনের গুঁড়ো। তার উপরেই নাচতে শুরু করলেন বাঈজিরা। আর তারই সঙ্গে, সেই সব গুঁড়ো দিয়ে আঁকতে লাগলেন একের পর এক ছবি। সেই দেখে চক্ষু ছানাবড়া বড়লাটের। ‘এমনও হয়!’ খুশি হয়ে বাঈজিদের একটি জাহাজের ছবি আঁকার বায়না ধরলেন বড়লাট। কিন্তু বাঈজিরা যে কোনও দিন জাহাজ দেখেননি। তাহলে কী হবে? শেষে তৎক্ষণাৎ বড়লাটের নির্দেশে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে নিয়ে আসা হল একটি জাহাজের ছবি। আবারও শুরু হল বাঈজি নাচের আসর। এবার নাচের তালে তালে বাঈজিদের পদচিহ্নে তৈরি হল এক মস্ত জাহাজের ছবি। তা দেখেই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন বড়লাট বেন্টিঙ্ক।
কেবল ইংরেজরাই নয়, সাধারণ মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থাও করা হত। আমন্ত্রিত থাকতেন সমাজের গণ্যমান্যরা ব্যক্তিরাও। বাঈজি নাচের শেষ হলে শুরু হত খেমটা, কবিগানের লড়াই, মোরগ লড়াই, যাত্রার মতো নানা বিনোদনের। সারা রাত জুড়েই উৎসব মুখর পরিবেশ রাজবাড়িতে। মনোরঞ্জনের জন্য থাকত মল্লযুদ্ধের ব্যবস্থাও। এমনকি ট্র্যাপিজ আর জিমন্যাস্টিকের খেলা দেখানোরও উল্লেখ পাওয়া যায়। বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা ও অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির গানের লড়াই হয়েছিল এই শোভাবাজার রাজবাড়ির নাটমন্দিরেই। এই বাড়ির পুজোয় আমন্ত্রণ পেতে তাই মুখিয়ে থাকতেন খোদ ইংরেজরাও।
সেই সময়ের একেক বছরের পুজোর খরচ শুনলেও ভিড়মি খেতে হয়। শোনা যায় রাজা কালীকৃষ্ণের সময়ে একেক বার পুজোয় খরচ হত প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ টাকা।
শোভাবাজারের দেব পরিবারের পুজোর ঘনঘটা দেখে নিজেদের বাড়িতে একটি করে দুর্গাপুজো করে সেখানে ইংরেজদের আমন্ত্রণ জানানো শুরু করেন কলকাতার অনেক বাবুরাই। ক্ষমতা এবং অর্থের জোর দেখাতে ক্রমে সেই পুজো ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে পরিণত হল রেষারেষিতে। শেষে ইংরেজদের নিয়ে বাবুদের মাতামাতি এমন দৃষ্টিকটু জায়গায় পৌছোঁয়, যে ১৮৪০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে থেকে আইন করে দুর্গাপুজোয় ব্রিটিশদের আনাগোনা বন্ধ করে দেয়।
সময় বদলেছে,ধীরে ধীরে কমেছে বাড়ির পুজোর আড়ম্বরের মাত্রাও। তবে পুজোর রীতিনীতিতে সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া আজও বজায় আছে সেই একই ধারা। সারা বছর বাড়ির সদস্যরা যে যেখানেই থাকুন না কেন, পুজোর পাঁচ দিন সকলে মিলে একসঙ্গে মেতে ওঠেন মাতৃ আরাধনায়। ষষ্ঠীর সন্ধে বেলা বেল বরণ, সপ্তমীর সকালে ব্যান্ড বাজিয়ে পদযাত্রা করে কলাবউ স্নান দেখার মতো। অষ্টমীতেও আছে বিশেষ চমক। এক সময়ে শোভাবাজার রাজবাড়িতে সন্ধিপুজো শুরু ও শেষে কামান দাগার চল ছিল। শহর ছাড়িয়ে যার শব্দ ছড়িয়ে পড়ত আশপাশের গ্রামেও। এখন আর কামান দাগা হয়না। তবে রেওয়াজে ফাঁক পড়েনি। সন্ধিপুজোর শুরু ও শেষ বোঝাতে রয়েছে শূন্যে বন্দুক দাগার রীতি। নবমী পেরিয়ে দশমীতে বাড়ির মেয়ে উমাকে বিদায় জানানোর পালা। বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় মেয়েরা কনকাঞ্জলি দিয়ে বাবা-মায়ের ঋণ শোধ করে, তেমনই উমাও কনকাঞ্জলি দিয়ে যান। একচালার সেই মাতৃ মূর্তি বাহকরা বয়ে নিয়ে যান ঘাট অবধি। তারপর সেই মূর্তি প্রথা মেনে নৌকায় ওঠে। আগে এক সময় বিসর্জনের আগে নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর চল ছিল। কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন তা আর হয়না। প্রতীক রূপে মাটির তৈরি নীলকন্ঠ পাখির মূর্তি বিসর্জনের আগে জলে ভাসান দেওয়া হয়। শেষে দুই নৌকা মাঝ গঙ্গায় গিয়ে দু’পাশে সরে যায়। আর মায়ের মূর্তি তলিয়ে যায় গঙ্গাবক্ষে। এরপর বাড়ি ফিরে কূলদেবতা গোপীনাথ-রাধারাণিকে প্রণাম জানানোর পালা। সঙ্গে শুরু আরও এক বছরের প্রতীক্ষার।