Women and marriage: ব্যান্ড ‘বাজার’ বারাত, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে ‘সৎপাত্র’দের কাছে চাকুরিরতাদের চাহিদা কম
Working Women Vs Housewife: সব সময় ব্যালান্স করে চলা মেয়েদেরই শিখতে হবে। ছেলেরাও কতটা তা শিখতে পারেন, তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ
‘পোস্তা গিয়ে’ নয়—‘ডিজিটাল ডেমোক্রেসি’র পৃথিবীতে ‘মেয়ের বিয়ে’র খবর (ছেলের বিয়েরও) আজকাল জানা যায় ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে। ৩৩ বছরের এষার জন্য অনেকদিন ধরেই হন্যে হয়ে পাত্র খুঁজছেন বাড়ির লোক। পরিচিতজন মারফত সন্ধান ছাড়াও ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটেও দেওয়া হয়েছিল বিজ্ঞাপন। ভারতীয় সংস্কৃতি এবং মানসিকতায় অনেকটাই ধরে নেওয়া হয় যে, বিয়ের সর্বোচ্চ বয়স হল ৪০। এরপর ছেলেরা যদিও বা বিয়ে করতে পারেন, মেয়েরা পারেন না। চাকরি, পড়াশোনা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে যে পাত্রীকেই সামান্য মনে ধরে পাত্রের পরিবারের, ‘বিবাহযোগ্যা’র উদ্দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নটাই থাকে খানিকটা এরকম: ‘‘মেয়ে রান্না করতে জানো কি না?’’ তারপরের প্রশ্ন: ‘‘কেরিয়ার নিয়ে কী ভাবছো?’’ এর ঠিক পরেই অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদের বাড়ির পক্ষ থেকে যে ‘আশ্বাসবাণী’ ভেসে আসে, তা হল: ‘‘আমার ছেলের যা রোজগার, তাতেই তোমার হেসেখেলে দিব্যি দিন চলে যাবে।’’ অর্থাৎ মেয়েটির চাকরি করে লাভ কী? মেয়েদের চাকরি ছেলেটির কাছে যেন তখন নিছকই সমাজসেবা! এই প্রসঙ্গে এষার মতো অনেকেই জানিয়েছেন, যখন বিয়ের প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু হয়, তখন মেয়ের চাকরি-পড়াশোনা নিয়ে ছেলেরা যতটা উৎসাহ দেখান, তার ছিটেফোঁটাও থাকে না বিয়ের কথা ‘পাকা’ হলে। মেয়েদের ‘কেরিয়ার’ নিয়ে তাঁরা উৎসাহী হলেও তাঁদের চাকরি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও উৎসাহ থাকে না পাত্রের বাড়ির।
‘বিয়ের বাজার’-এ ভারতীয় কর্মরতাদের ‘দর’ কতটা, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছেন দিবা ধর। তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ব্লাভাটনিক স্কুল অফ গভর্নমেন্টের গবেষক। গবেষণার জন্য ২০ জন মেয়ের ভুয়ো প্রোফাইল তৈরি করে ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে পোস্ট করেন দিবা। এই ২০ জন মেয়ের বয়স, খাদ্যাভ্য়াস, পছন্দ-অপছন্দ প্রায় অভিন্ন প্রকৃতির হলেও একমাত্র পার্থক্য তৈরি করা হয়েছিল তাঁদের ‘কেরিয়ার’-এর ক্ষেত্রে: (১) তিনি কাজ করেন কি না, (২) কত উপার্জন তাঁর, (৩) বিয়ের পরও তিনি চাকরি চালিয়ে যেতে চান কি না।
মোট ১০০ জন পুরুষকে এই সমীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়। সেখানে মাত্র ১৫-২২% জানিয়েছেন, তাঁদের পাত্রী হিসেবে কর্মরতাদের পছন্দ। আর ৭৮-৮৫% জন জানিয়েছেন, তাঁরা কর্মরতাদের স্ত্রী হিসেবে মোটেই চান না। অর্থাৎ সহজ কথায়: চাকরি করেন না, এমন মেয়েদের যেখানে বিয়ের জন্য বেছে নিয়েছেন ১০০ জন পুরুষ, সেখানে ঘরকন্নার কাজের বাইরে ‘কেরিয়ার-করা’ মেয়েদের জীবনসঙ্গী করে তুলতে আগ্রহী ৭৮-৮৫ জন।
বর্তমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে দিবার এই সমীক্ষা—যদিও তা মাত্র ২০ জন ‘বিবাহযোগ্যা’র ভুয়ো প্রোফাইল ‘ক্রিয়েট’ করে চালানো—রীতিমতো কপালে ভাঁজ ফেলার মতো। প্রতিনিয়ত লিঙ্গসাম্য, ছেলে-মেয়েদের সমান-অধিকারের কথা-বলা তথাতথিত শিক্ষিত সমাজে বিয়ের বাজারে মহিলাদের প্রতি এ কোন মনোভাব? ‘মেল ইগো’ কি এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে? বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের School of Women’s Studies-এর Director ঐশিকা চক্রবর্তীর সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘লকডাউন এবং বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দার কারণে কোপ পড়েছে কাজে। বেড়েছে বেকারত্বের সংখ্যা। স্ত্রী-এর হাতে কাজ রয়েছে, অথচ স্বামীর চাকরি খোয়া গিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক চাপ তো থাকছেই। সেই সঙ্গে সংসার-সন্তান এসবও থাকছে। মেয়েদের চাকরি নিয়ে বিতর্ক চলছে বহুদিন ধরে। সমাজ মেয়েদের দ্বৈত ভূমিকাতেই দেখে এসেছে সব সময়। মেয়েরা রান্নাও করবে, বাচ্চাদের পড়াবে আবার চাকরিও করবে। পরিবার, সমাজ এবং নারীদের ভূমিকা নিয়ে এত বিপ্লবের পরও এই ছবিতে বদল আসেনি।’’
ঐশিকার আরও সংযোজন, ‘‘ছেলেরা বাড়ির কাজ ভাগ করে নিচ্ছেন, রান্না করছেন—এমন ছবি খুব কম বাড়িতেই দেখা যায়। বাড়ির ছেলেটি বা স্বামী যদি কোনও একদিন ঘরকন্না সামলে ফেলেন, তখন গর্বিত স্ত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন: আমার স্বামী আজ ডিনার বানিয়েছেন কিংবা বাচ্চার জন্য আমার স্বামীও আমার সঙ্গে রাত জেগেছেন। কোথাও গিয়ে তাঁরা একরকম জোর করেই যেন প্রমাণ করতে চাইছেন, এই সব কাজ ছেলেদের জন্য নয়। তাই ভুল করে ছেলেরা সবাইকে ধন্য করে দিয়েছেন।’’ ঐশিকা আরও বলেছেন, ‘‘এখনও ‘পাত্রী চাই’-এর বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে, কনভেন্ট এডুকেটেড মেয়ে চাই, তবে ঘরোয়া হতে হবে। সব সময় ব্যালান্স করে চলা মেয়েদেরই শিখতে হবে। ছেলেরাও কতটা তা শিখতে পারেন, তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। এছাড়াও আরও একটি কারণ হতে পারে: স্বামীরা চাইছেন না, প্রতি মুহূর্তে স্ত্রী-রাও চাকরি নিয়ে তাঁদের প্রতিযোগিতায় ফেলুক। তবে হঠাৎ করে কেন ছেলেরা এমনটা চাইছেন, তা-ও ভেবে দেখা প্রয়োজন।’’
দিবার সমীক্ষা অনুযায়ী: পাত্রদের কাছে স্বামীর চেয়ে বেশি রোজগার করেন, এমন স্ত্রী-এর চাহিদা চাকরি করেন না এমন স্ত্রী-এর তুলনায় ১০% কম। আবার স্বামীর চেয়ে কম রোজগার করেন, এমন স্ত্রী-এর চাহিদা চাকরি করেন না এমন স্ত্রী-এর তুলনায় ১৫% কম। বিয়ের বাজারে চাকুরিরতা মেয়েদের চাহিদা কেন কম, এই প্রসঙ্গে সমাজকর্মী পিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গলদ রয়েছে গোড়াতেই। ছোট থেকেই আমরা ছেলেদের হাতে খেলনা হিসেবে তুলে দিই গাড়ি, বল আর মেয়েদের খেলনা-বাটি। কোথাও গিয়ে ছোট থেকেই আমরা বুঝিয়ে দিতে চাই যে, বাড়ির সব কাজ সামলাবে মেয়েরা আর বাইরের কাজ ছেলেরা। ‘মেল ইগো’ নিয়ে কেউ জন্মায় না, তা আমরাই মনের মধ্যে তৈরি করে দিই। পুরুষতন্ত্রকে সহজে ভেঙে ফেলা মুশকিল। হাজার-হাজার বছর ধরে লড়াইয়ের ফলে তাতে খানিক চিড় ধরেছে, তবে শিকড় এখনও গভীরে নিহিত। চাকুরিরতা মায়েদের এখনও অপরাধবোধ কাজ করে যে, ‘আমি বাচ্চাকে ঠিকমতো সময় দিতে পাচ্ছি না’ বা ‘আমি ঘরের কাজে বিশেষ মন দিতে পারি না’। আসলে মহিলাদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কাজ করাটা সমাজ মেনে নিয়েছে ততদূরই, যখন সে ঘরে এবং বাইরে সমানভাবে সামাল দিতে পারবে। যে প্রত্যাশাটা ছেলেদের মধ্যে থাকে না।’’
পিয়া আরও বলেন, ‘‘যদি সমীক্ষা এমন বলে যে, সব মহিলা বাড়িতেই থাকেন এবং বিয়ের বাজারে তাঁদের কদর বেশি, তাহলে আমি বলব আমাদের সমাজ এখনও যে কতটা পিছিয়ে আছে—নারীবাদ আন্দোলনের এখনও কতটা পথচলা বাকি, তা এই প্রশ্নই তুলে দেয়। এখনও আমরা যে Regressive সমাজব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি, তা-স সুস্পষ্ট এই সমীক্ষায়। আমরা সবসময় জোর দিয়ে বলি মেয়েদের উপার্জন করতে হবে। কোথাও গিয়ে কি জোর দিয়ে বলি যে, ছেলেদেরও বাড়ির কাজ শিখতে হবে? নইলে চিরকালই এই ব্যবস্থায় কোনও পরিবর্তন আসবে না। ছেলেদের এটা না শেখালে, তাঁদের পার্টনার খুঁজতে গেলেও এই একই সমস্যা থেকে যাবে। ছেলেদের কি আমরা নারীবাদের যৌক্তিকতা বোঝাতে পারি? উল্টো দিকটাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার।’’