AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

Kurukhetra War Explained: যুদ্ধের জন্য কতটা অপেক্ষা করতে হয়, জানুন কুরুক্ষেত্র থেকে

Mahabharat Explained: মহাভারতের সবচেয়ে বড় এবং বীর খলনায়ক ধৃতরাষ্ট্রের জেষ্ঠ্য পুত্র দুর্যোধন। তাঁর অধিক যুদ্ধ কেউই বোধহয় চাননি। অথচ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধ হতেই সেই দূরাচারী দুর্যোধনের গলাতেও ছিল আক্ষেপে সুর। এত আফসোস, এত ধ্বংসলীলা না চালিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কি ঠেকানো যেত না?

Kurukhetra War Explained: যুদ্ধের জন্য কতটা অপেক্ষা করতে হয়, জানুন কুরুক্ষেত্র থেকে
| Updated on: May 01, 2025 | 8:18 PM
Share

যুদ্ধ— কেউ করেন ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কেউ করেন নিজের ক্ষমতা, আধিপত্য, অহংকারের বহিঃপ্রকাশ করার জন্য। কেউ করেন সম্মান রক্ষার্থে, কেউ করেন সম্মান হরণ করতে। কেউ করেন জায়গা-জমি-সম্পত্তির জন্য। কেউ করেন প্রেমিকা, বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের জন্য। এই সব কারণ খুঁজে পাওয়া যায় একটি যুদ্ধে। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং ভয়ানক যুদ্ধ। যে যুদ্ধের কথা ভাবলে আজও শিহরিত হয়ে ওঠে প্রাণ! হ্যাঁ, বলছি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা।

কেউ মনে করেন এটা নিছকই কল্পনা মাত্র। কারও বিশ্বাস এই ঘটনা ধ্রুব সত্য। কারও মতে রামায়ণ-মহাভারত সাহিত্য। সে যাই হোক না কেন, মহাভারতের প্রতিটা অক্ষরে যে বাস্তবের মানব চরিত্র, তাঁদের ভাবনা-চিন্তা স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা অস্বীকার করা যায় না। মহাভারতে যা যা ঘটেছে, তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যা যা হয়েছে, একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেই সব ঘটনা আমাদের চারপাশেও ঘটে চলেছে নিয়মিত। যুদ্ধ যে কারণেই হোক না কেন যে কোনও যুদ্ধই যে দিনের শেষে ক্ষতি আর শূন্য বাটি নিয়ে ফিরে আসে তা মেনে নিয়েছেন অতি বড় যুদ্ধবাজরাও।

মহাভারতের সবচেয়ে বড় এবং বীর খলনায়ক ধৃতরাষ্ট্রের জেষ্ঠ্য পুত্র দুর্যোধন। তাঁর অধিক যুদ্ধ কেউই বোধহয় চাননি। অথচ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধ হতেই সেই দূরাচারী দুর্যোধনের গলাতেও ছিল আক্ষেপে সুর।

রাজশেখর বসু মহাভারতের সারানুবাদে লিখেছেন, দ্রোণবধের দিন প্রাতঃকালে সাত্যকিকে দেখে দুর্যোধন বলেছেন, ‘সখা, ক্রোধ লোভ ক্ষত্রিয়াচার ও পৌরুষকে ধিক। আমরা পরস্পরের প্রতি শরসন্ধান করছি! বাল্যকালে আমরা পরস্পরের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় ছিলাম, এখন এই রণস্থলে সে সমস্তই জীর্ণ হয়ে গেছে। সাত্যকি, আমাদের সেই বাল্যকালের খেলা কোথায় গেল, এই যুদ্ধই বা কেন হল? যে ধনের লোভে আমরা যুদ্ধ করছি তা নিয়ে আমরা কি করব?’ এই কথার মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পায় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নিয়ে দুর্যোধনের মধ্যে তৈরি হওয়া আফসোসের কথা।

এত আফসোস, এত ধ্বংসলীলা না চালিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কি ঠেকানো যেত না? যুদ্ধ শুরুর আগে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে সামনে নিজের আত্মজনকে দেখে অস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন অর্জুন। তখন নিজের বিশ্বরূপ দেখিয়ে অর্জুনকে যুদ্ধ করার শক্তি জুগিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাই তাঁর বিরুদ্ধে অনেকেই এই যুদ্ধে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ তোলেন। কিন্তু মহাবিধ্বংসী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ফলাফল বহু আগেই জানতেন কৃষ্ণ। তাই এই যুদ্ধ আটকানোর চেষ্টা করেছেন তিনি বারবার।

পাশা খেলায় হেরে সব ত্যাগ করে বার বছর বনবাস এবং এক বছর অজ্ঞাতবাসে যান পাণ্ডবরা এবং দ্রৌপদী। সেই শর্ত মেনে ফিরে এলে শ্রীকৃষ্ণ বলরামের পরামর্শে যুদ্ধ এড়াতে এবং পাণ্ডবদের ন্যায় অধিকার দাবি করতে কৌরবদের কাছে যান। কৃষ্ণ জানান, ছলপূর্বক কৌরবরা পাণ্ডবদের সব কিছু হরণ করেছিল। তথাপি নিজের কথা রেখেছেন তাঁরা। এখন তাঁদের পিতৃ সম্পত্তি ফিরে পেতে প্রণিপাত করতে হবে কেন? যুধিষ্ঠির বেশি কিছু চান না, কেবল একটি গ্রাম দিলেই হবে। সাত্যকি বলেন, “ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে বরং বলা হোক, যদি আপনারা শান্তি চান তবে মিষ্টবাক্যে দূর্যোধনকে প্রসন্ন করুন। সাম নীতিতে যা পাওয়া যায় তাই অর্থকর, যুদ্ধ অন্যায় ও অনর্থকর।”

কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। শুরু হল যুদ্ধের প্রস্তুতি। দাম্ভিক দুর্যোধনের কাছে মিষ্টবাক্য দুর্বলতার সমান। এদিকে গুপ্তচরের কাছে পাণ্ডবদের ধারভারের কথা শুনে পুত্রদের হারানোর ভয় পেলেন ধৃতরাষ্ট্র। তাই সঞ্জয়কে দূত হিসাবে পাঠিয়ে সন্ধি স্থাপনে উদ্যত হয়েছিলেন তিনিও। ধৃতরাষ্ট্র বলেন, “ভীম অর্জন নকুল সহদেব এবং কৃষ্ণ ও সাত্যকি যাঁর অনুগত সেই যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধের পূর্বেই তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া ভাল। গুপ্তচরদের কাছে কৃষ্ণের যে পরাক্রমের কথা শুনেছি তা মনে করে আমি শান্তি পাচ্ছি না, অর্জন ও কৃষ্ণ মিলিত হয়ে এক রথে আসবেন শুনে আমার হৃদয় কম্পিত হচ্ছে। যুধিষ্ঠির মহাতপা ও ব্রহ্মচর্যশালী, তাঁর ক্রোধকে আমি যত ভয় করি অর্জন কৃষ্ণ প্রভৃতিকেও তত করি না। সঞ্জয়, তুমি রথারোহণে পাঞ্চালরাজের সেনানিবেশে যাও এবং যুধিষ্ঠির যাতে প্রীত হন এমন কথা বলো। সকলের মঙ্গল জিজ্ঞাসা করে তাঁকে জানিও যে আমি শান্তিই চাই।”

সঞ্জয় সেই মতো শান্তির বার্তা নিয়ে পৌঁছেছিলেন পাণ্ডব শিবিরে। সেই কথা শুনে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, “তোমার অনুরোধে সমস্তই ক্ষমা করতে প্রস্তুত আছি; কৌরবদের সঙ্গে পূর্বে আমাদের যে সম্বন্ধ ছিল তাও অব্যাহত থাকবে, তোমার কথা অনুসারে শান্তিও স্থাপিত হবে। কিন্তু দুর্যোধন আমাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিন, ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্য আবার আমার হোক।”

এও বলেন, “দূর্যোধনকে বলো, নরশ্রেষ্ঠ, পরদ্রব্যে লোভ করো না। আমরা শান্তিই চাই, তুমি রাজ্যের একটি প্রদেশ আমাদের দাও। অথবা আমাদের পাঁচ ভ্রাতাকে পাঁচটি গ্রাম দাও-কুশস্থল বুকস্থল মাকন্দী বারণাবত এবং আর একটি, তা হলেই বিবাদের অবসান হবে। আমি সন্ধি বা যুদ্ধ উভয়ের জন্য প্রস্তুত।”

তবে এখানেই শেষ নয়। এর পরেও শ্রীকৃষ্ণ শান্তি স্থাপনের জন্য দুর্যোধন এবং ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে যান। কিন্তু দূরাত্ম্যা দুর্যোধন সেই প্রস্তাব গ্রহণতো করেননি উলটে বাসুদেবকেই বন্দি বানানোর ফন্দি করেন। যদিও সেই চেষ্টা বিফলে যায়। অবশেষে খালি হাতেই ফিরে আসেন কৃষ্ণ। যুদ্ধই হয় শেষ পথ।

এতক্ষণ ধরে যা ঘটেছে, সেই ঘটনাক্রম পড়লে হয়তো সকলেই মনে করবেন অনেকের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কেবল দুর্যোধনের গোঁয়ার্তুমি আর লোভই এই ভয়ানক যুদ্ধের নেপথ্যে দায়ী। তবে আরেকটি কথাও মনে রাখা জরুরি। শ্রীকৃষ্ণ সর্বজ্ঞানী। কখন, কী হবে তা সব আগে থেকেই তো জানতেন! তাহলে পরিস্থিতি এতটা গুরুতর হতে দিলেন কেন? সত্যিই কি তিনি শান্তি স্থাপনের জন্য যুদ্ধ এড়িয়ে সন্ধিচুক্তি করতেই হস্তিনাপুর গিয়েছিলেন, নাকি সেটা ছিল কেবলই এক কূটনৈতিক চাল? যাতে ধ্বংসলীলা সাঙ্গ হলে কেউ তাঁর বা পাণ্ডবদের দিকে আঙুল তুলে না বলতে পারে এই হত্যালীলার দায় তাঁদেরও। এমনকি সন্ধি চুক্তি করতে যাওয়ার আগেও কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, “দুর্যোধন পাপমতি তা আমি জানি, কিন্তু আমি যদি সন্ধির জন্য তাঁর কাছে যাই তবে অন্য লাভ না হলেও লোকে আমাদের যুদ্ধপ্রিয় বলে দোষ দেবে না,কৌরবগণ আমাকে ক্রুদ্ধ করতেও সাহস করবেন না।”

যদিও সেই সময় ভীমের মুখে শান্তির বাণী শুনে তাঁকে যুদ্ধের জন্য তাতাতে একবারও দ্বিধাবোধ করেননি কৃষ্ণ। যা শ্রীকৃষ্ণের সন্ধি চুক্তি করার অভিসন্ধির উপরেও একটা প্রশ্ন তুলে দেয়। আসলে যুদ্ধ কেবল রাজায় রাজায় হয় না। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সমগ্র দেশের মানুষের ভাল-মন্দ। তাই যুদ্ধ জয়ের প্রথম ধাপ হল নিজের দেশের মানুষের সমর্থন আদায় করে নেওয়া। কৃষ্ণের মতো পাকা মাথার রাজনীতিক যে সেই কাজটা আগেই সেরে নেবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বরং একটা ব্যর্থ সন্ধি চুক্তি করতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ শুধু নিজের দেশবাসী নয় তার সঙ্গে সমগ্র হস্তিনাপুরবাসী, দেবগণ, মুনিঋষিগণের সমর্থন জোগাড় করে নেন। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের আগে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে সঞ্জয়ের কথোপকথোন থেকেই বোঝা যায় কেবল শকুনি, কর্ণ এবং দুর্যোধন ব্যতিত আর কোনও যোদ্ধাই মন থেকে কৌরবের পক্ষে ছিল না। এর থেকে বড় কূটনৈতিক সাফল্যই বা আর কী হতে পারে?

শ্রীকৃষ্ণ সন্ধি চুক্তির সময়ে ওই ব্যপক সাম্রাজ্যের মধ্যে থেকে মাত্র পাঁচটা গ্রাম বা একটি প্রদেশ চেয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাও মানেনি দুর্যোধন। এত গুলো প্রাণ বাঁচাতে এই সামান্য দান কি করা যেত না? অবশেষে নিরুপায় হয়েই যুদ্ধ ঘোষণা। এমন ছবি তৈরি করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। হস্তিনাপুরের সভায় দাঁড়িয়েও শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন আমি চাইলে এই মুহূর্তে দুর্যোধনকে বন্দি বানিয়ে পঞ্চ পাণ্ডবদের কাছে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু তা করব না। আসলে কোন পরিস্থিতি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে তাই যেন ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন সর্বকালের সেরা রাজনীতিক।