হাতে আর মাত্র ১৪-১৫ দিন। তারপরেই মায়ের বোধন। মহাষষ্ঠী! শরতের আকাশে-বাতাশে আগমনীর সুর বেজে উঠেছে ইতিমধ্যেই। দশভুজা, অসুরদলনী মা দুর্গা পূজিত হবেন দিকে দিকে। সঙ্গে আসবেন তাঁর ছেলে মেয়ে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। আর মায়ের পায়ের কাছে ত্রিশূল বিদ্ধ হয়ে থাকেন অসুররাজ মহিষাসুর। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করেই উৎসবে মেতে ওঠে গোটা বিশ্বও।
তবে আপনি কি জানেন যখন সারা বিশ্ব উৎসবে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে তখনই শোকে মুহ্যমান থাকে পুরুলিয়ার এক আদিবাসী সম্প্রদায়। দুর্গার আগমনের উৎসব নয় বরং মহিষাসুরের পরাজয়ের শোক পালন করেন তাঁরা। কিন্তু হঠাৎ কেন এমন উলটপুরাণ? কোথায় ঘটে এমন আজব ঘটনা?
পুরুলিয়া জেলার ফলাওরা গ্রাম। সেখানেই বাস খেরওয়াল সাঁওতালদের। তাঁদের মতে দুর্গা আসলে এক উচ্চবর্ণের নারী। যিনি ছল করে তাঁদের রাজা হুদুর দুর্গা অর্থাৎ মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। তাই এখানে দুর্গতিনাশিনী নয় পুজো পান মহিষাসুর। নিজেদের জন্য নতুন জামা, নতুন জিনিস কেনার বদলে অসুররাজকে উৎসর্গ করতে কেনা হয় উপহার। এই শোকের সময় তাঁদের কাছে ‘দশাই; নামে পরিচিত।
কিন্তু কে এই হুদুর দুর্গা এবং কেনই বা মা দুর্গার বদলে তিনি পূজিত হন?
বিশেষ এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস সাঁওতাল সম্প্রদায় গঠনের আগে তাঁরা খেরওয়ালদের বংশধর ছিলেন। তাঁদের শাসক চাইচম্পা নামে এক অঞ্চলের তত্ত্বাবধান করতেন। এই চাইচম্পা প্রথমে ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। এখানে খেরওয়ালরা একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতেন।
তবে হঠাৎই কিছু অনুপ্রবেশকারীর আক্রমণ নেমে আসে এই জনপদে। অনুমান সম্ভবত সেই সম্প্রদায় ছিল আর্য। তবে খেরওয়ালদের বীরত্ব, শক্তি এবং সাহস এবং রাজার বুদ্ধিমত্তার কাছে হার মানতে হয় তাঁদের।
তাৎক্ষনিক ভাবে হার মানলেও হাল ছাড়েনি অনুপ্রবেশকারীরা। শুরু হয় রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। খেরওয়ালরা নারীদের আক্রমণ করত না। এই সহবতকেই কাজে লাগাতে উদ্যত হয়ে উঠল ষড়যন্ত্রকারীরা।
আর্যরা ইচ্ছে করে খেরওয়াল রাজার সঙ্গে তাঁদের এক কন্যার বিয়ে দিলেন। এরপর সেই নববিবাহিত স্ত্রীর হাতেই খুন হতে হয় রাজা মহিষাসুরকে। রাজার মৃত্যুর পরে প্রাণ বাঁচাতে খেরওয়ালদের নিজের জায়গা-জমি ছেড়ে পালানো ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। শত্রুদের হাত থেকে বাঁচতে পুরুষেরাও মহিলা সেজে পালাতে বাধ্য হলেন। সেই দিন থেকেই এই আদিবাসী সম্প্রদায় একে হুদুর দুর্গার শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন।
শুধু পুরুলিয়া নয়, অসুর অথবা মহিষাসুর পুজোর ঐতিহ্য বাংলার আরও বেশ কিছু আদিবাসী গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে, যা হুদুর দুর্গা নামে পরিচিত। উপজাতি ও দলিত সম্প্রদায়, যেমন বাগদি, সাঁওতালি, মুন্ডা, নমঃশূদ্ররা মহিষাসুরের শহিদ দিবস পালন করেন।