চলছে ভারতের অন্যতম সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মহাকুম্ভ ২০২৫। দেশ-বিদেশ থেকে কোটি কোটি ভক্ত, সাধু, অঘোরি, পুণ্যার্থীরা এসে ভিড় করেছেন উত্তর প্রদেশের ত্রিবেণী সঙ্গম, প্রয়াগরাজে। উদ্দেশ্য প্রধানত একটাই পুণ্য লগ্নে গঙ্গাস্নান করে নিজের সব পাপ ধুয়ে নেওয়া। তবে এই বছরের কুম্ভ অনান্য বছরের তুলনায় একটু অন্যরকম। জ্যোতিষ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৪৪ বছরে একবার এমন বিরল যোগ আসে। তাই তো এই কুম্ভের নাম ‘মহাকুম্ভ’। কোন বিরল যোগের কারণে এই কুম্ভ মহাকুম্ভ? কত রকমের কুম্ভ হয়? কুম্ভ মেলা কী শুধুই ধর্মীয় অনুষ্ঠান? কী ভাবে ঠিক হয়, কোথায় হবে কুম্ভ? সাধুদের সঙ্গেই বা এই মেলার কী যোগ? কবে শুরু হয়েছিল প্রথম কুম্ভ মেলা? এই সব প্রশ্নের উত্তর রইল এই প্রতিবেদনে।
ইতিহাস কথা বলে –
কুম্ভ মেলা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। তবে এই মেলা যে কয়েক শো বছরের পুরনো তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অনেকের মতে অষ্টম শতাব্দীতে হিন্দু দার্শনিক ও সাধু আদি শঙ্করাচার্য ভারত জুড়ে মঠ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সমাবেশ করেন। মনে করা হয় সেই সময় তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল কুম্ভ মেলার।
যদিও এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে ১৯ শতকের আগে ভারতে এত বড় তীর্থযাত্রার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না, এমনকি সাহিত্যেও উল্লেখ নেই। আবার অনেক প্রাচীন পান্ডুলিপি ও শিলালিপিতে ৬ বা ১২ বছর অন্তর বার্ষিক মাঘ মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে পবিত্র নদী বা কুন্ডে স্নান করার উল্লেখ রয়েছে। যা অনেকটাই কুম্ভ মেলার মতোই।
ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় হত মেলা –
স্বাধীনতার আগে এই কুম্ভ মেলার আয়োজন করত খোদ ব্রিটিশ সরকার। সেই সময়ে কেবল কুম্ভ মেলার খুঁটিনাটি, সুরক্ষার দিক সব খতিয়ে দেখতে ইংল্যান্ড থেকে জেনারেল পদমর্যাদার অফিসার আসতেন শুধুমাত্র কুম্ভ মেলার আয়োজনের তদারকি করতে। ক্রমে দেশ স্বাধীন হয়, ১৯৫৪ সালে প্রয়াগরাজেও প্রথম আয়োজন হয়েছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম কুম্ভ মেলার। কুম্ভে গিয়ে গঙ্গাস্নান করেছিলেন খোদ জহরলাল নেহেরু, উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদও। সেই বছর সেই কুম্ভ মেলায় অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ১২ কোটি মানুষ।
কেন শুরু হল কুম্ভ, জানুন পুরাণ –
কুম্ভ মেলা কী ভাবে শুরু হল তা নিয়ে পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে। একবার ঋষি দুর্বাসার অভিশাপে শ্রী হীন হয়ে পরে দেবতারা। ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী আশ্রয় নেন পাতাল লোকে। অন্ধকার ছেয়ে যায় বৈকুন্ঠ লোকেও। এর পরেই ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন দেবতারা। তাঁর পরামর্শে দেবতারা অসুরদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন সমুদ্র মন্থন। একের পর এক মূল্যবান হিরে-মানিকের সঙ্গে উঠে আসে কলস ভর্তি অমৃত।
অমৃতর ঘড়া উঠে আসতেই তা দাবি করে বসেন অসুররা। তখন ১২ দিন ধরে সেই ঘড়াকে নিয়ে অসুর এবং দেবতাদের মধ্যে চলে ভীষণ যুদ্ধ। সেই সময় পৃথিবীর চারস্থানে চার ফোঁটা অমৃত পড়ে যায়। সেই সময় চন্দ্র কুম্ভকে ক্ষরণ থেকে, সূর্য কুম্ভ বিস্ফোরণ থেকে, দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরদের অপহরণ থেকে এবং শনি দেবেন্দ্রের ভয় থেকে অমৃতের ঘটকে রক্ষা করেছিলেন। শেষে ভগবান বিষ্ণু মোহিনী অবতারে অমৃত বন্টন করে যুদ্ধের অবসান ঘটান। দেব-অসুরের ১২ দিনের যুদ্ধ মনুষ্য লোকে ১২ বছরের সমান। তাই ১২টি কুম্ভ রয়েছে। যার ৪টি (প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার , উজ্জয়িনী , নাসিক) রয়েছে পৃথিবীতে বাকি ৮ কুম্ভ আছে দেবলোকে। মনুষ্য লোকের এই ৪ কুম্ভেই গ্রহের অবস্থান দেখে আয়োজন করা হয় কুম্ভ মেলার।
কুম্ভ কত রকম –
পৃথিবীতে ৪ রকমের কুম্ভমেলা আয়োজিত হয়।
১) পূর্ণ কুম্ভ – প্রতি ১২ বছর অন্তর প্রয়াগরাজে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমে আয়োজিত হয় পূর্ণ কুম্ভ মেলা।
২) অর্ধ কুম্ভ – প্রত্যেক ৬ বছর অন্তর গ্রহের অবস্থান দেখে অর্ধ কুম্ভের আয়োজন করা হয়, প্রয়াগরাজ বা উজ্জয়িনীতে।
৩) কুম্ভ – প্রত্যেকে ৩ বছর অন্তর গ্রহের অবস্থান দেখে আয়োজিত হয় কুম্ভ মেলা। এমনকি সেই অনুসারেই ৪ কুম্ভের মধ্যে কোথায় সেই বছর মেলা লাগবে তা ঠিক করা হয়।
কুম্ভমেলার তারিখ নির্ধারণ করা হয় সূর্য ও বৃহস্পতির অবস্থান দেখে। কখন ও কোথায় কুম্ভ মেলার আয়োজন করা হবে তা নির্ধারণ করা হয় গ্রহ ও রাশিচক্রের অবস্থান দেখে।
বৃহস্পতি বৃষ রাশিতে ও সূর্য মকর রাশিতে থাকলে প্রয়াগে মেলার আয়োজন করা হয়।
যখন সূর্য মেষ রাশিতে থাকে ও বৃহস্পতি কুম্ভ রাশিতে থাকে তখন হরিদ্বারে কুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়।
যখন সূর্য এবং বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে থাকে, তখন নাসিকে কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
বৃহস্পতি যখন সিংহ রাশিতে এবং সূর্য মেষ রাশিতে থাকে, তখন উজ্জয়িনীতে কুম্ভের আয়োজন করা হয়।
৪) মহাকুম্ভ – এবারে এই বছরের মূল আকর্ষণ মহাকুম্ভের কথায়। মহাকুম্ভ অনুষ্ঠীত হয় ১৪৪ বছরে একবার। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, মেষ রাশির চক্রে বৃহস্পতি, সূর্য ও চন্দ্র মকর রাশিতে প্রবেশ করলে মহাকুম্ভ মেলার আয়োজন করা হয়।
আসলে ১২ বছরের পূর্ণ কুম্ভের ১২টি চক্র পূর্ণ হলে তবেই তৈরি হয় মহাকুম্ভের যোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে কেউ খুব ভাগ্যবান হলে নিজের সারা জীবনে একবার এই মহাকুম্ভে যাওয়ার সুযোগ পান।
সাধু সন্ন্যাসীদের কাছে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মহাকুম্ভ?
কেবল মহাকুম্ভই নয়, নাগা সাধু, সন্ন্যাসী, অঘোরিদের কাছে সব কুম্ভই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে নিজের ব্রহ্মচারী দশার কঠোর ত্যাগের পরে নাগা সাধু হওয়ার যোগ তৈরি হয়। অঘোরিরাও বিশেষ যোগের সময় নানা ধরনের পুজো পাঠ, সাধনা করে থাকেন। বিশ্বাস, কুম্ভ মেলায় ৪৫ দিন ধরে কল্পবাসের পরে সাধনা করে পুণ্য লগ্নে গঙ্গায় মহাস্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়। তাই দেশ-বিদেশ থেকে সকলে এসে ভিড় জমান এই কুম্ভ মেলায়।
পৌরাণিক বিশ্বাস মহাকুম্ভের সময় পৃথিবীতে স্বর্গের দরজা খুলে যায়, দেবতারাও পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং পবিত্র সঙ্গমে স্নান করেন। শিবপুরাণ অনুসারে, ভগবান শিব, দেবী পার্বতী এবং কৈলাসের অন্যান্য বাসিন্দারা মাঘ পূর্ণিমার দিনে ছদ্মবেশে কুম্ভে আসেন। জ্যোতিষীরা বলছেন, এই সময়ে সূর্য, শনি, চন্দ্র ও বৃহস্পতির অবস্থান সাগর মন্থনের সময়ে যেমন ছিল। এটি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বৃদ্ধি করে এবং মানবদেহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই মহাকুম্ভ মেলা আধ্যাত্মিক পাশাপাশি বস্তুগত দিক থেকেও উপকারী।
কুম্ভ মেলা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন –
সরকারের অনুমান এবারে প্রায় ৪০-৪৫ কোটি ভক্ত সমাগম ঘটবে কুম্ভ মেলায়। ফলে সেই ভাবেই প্রস্তুত রয়েছে প্রশাসন। এত বড় মেলার আয়োজন, সুরক্ষা নিশ্চিত করা যেমন ঝামেলার তেমনই আরেকদিক থেকে আশার আলো দেখছে প্রশাসন। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে পর্যটন ব্যবসায় ভাল গতি আসবে, এই মেলাকে কেন্দ্র করে।
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, যদি ৪০ কোটি পুণ্যার্থী গড়ে ৫ হাজার টাকাও খরচ করলে, তবে ২ লক্ষ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে। মেলার আয়োজনে প্রশাসনের খরচ হয়েছে আনুমানিক ১৬ হাজার টাকা। সরকাররে আশা ৪৫ দিনে জিএসটি বাবদ অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা লাভ হতে পারে। সব মিলিয়ে সরকারের ঘরে রাজস্ব আসতে পারে ১ লক্ষ কোটি টাকা। লাভবান হবেন ছোট থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীরাও। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত এই লাভ শুধু রাজ্যের অর্থনীতিকে নয়, বরং দেশের জিডিপিকেও ১ শতাংশ বাড়িয়ে দিতে পারে।
সব মিলিয়ে মহাকুম্ভ যে এই মুহূর্তে উত্তর প্রদেশ সরকারের সবচেয়ে বড় যজ্ঞ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর এই যজ্ঞ ভালভাবে সফল হলে আধ্যাত্মিক উন্নয়নের সঙ্গেই প্রভুত লাভবান হবে দেশের অর্থনীতিও। নাস্তিক হন বা আস্তিক, ভারতবর্ষের বিবিধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যেও ঐক্যকে খুঁজে পেতে হলে, প্রাচীন সংস্কৃতির স্বাদ নিতে গেলে একবার অন্তত এই মহাকুম্ভে যাওয়া উচিত বলেই মনে করেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।