৬২৩ বছরের ইতিহাসের সঙ্গী। বাংলার (West Bengal) প্রাচীনতম ও ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা (Ratha Yatra 2022) হিসেবে বিখ্যাত হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ (Mahesh Rath)। পুরীর (Puri) পর রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে এমন সমারোহ পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। এই মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে পা রেখেছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। মাহেশকে তিনিই ‘নব নীলাচল’ আখ্যা দেন। অনুমান করা হয়, হুগলি জেলার মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের রথই বাংলার প্রাচীনতম রথ। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে বলা হয়ে থাকে পুরীর দেবতা জগন্নাথ নাকি গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে মাহেশে এসে সেখানে থেকে যেতে মনস্থ করেন। সেই অনুসারে সেখানে জগন্নাথ মন্দির তৈরি হয় ইতিহাস-পূর্বকালে। এখানের রথের মেলায় পা পড়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণেরও।
পুরীকে বলা হয় নীলাচল, আর মাহেশের অন্য নাম নব নীলাচল। এক হাজার শালগ্রাম দিয়ে তৈরী রত্নবেদীতে প্রতিষ্ঠিত তিন দেবতা। নব নীলাচল আরও এক মাহাত্ম্যে আলাদা নীলাচল থেকে। পুরীতে তিন দেবতা দাঁড়িয়ে আছেন এক লক্ষ শালগ্রাম শিলার ওপর তৈরি বেদীতে। কিন্তু মাহেশে মহাপ্রভু, সুভদ্রা ও বলভদ্র বেদিতে উপবিষ্ট আছেন। প্রতি বারো বছর অন্তর পুরীতে নিমকাঠ দিয়ে নতুন মূর্তি তৈরি করে অভিষেক হয়। মাহেশে ৬২৪ বছর একই মূর্তিতে চলছে।
কথিত রয়েছে, সালটা ১৫১০। ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী দীর্ঘদিন ধরেই মনের অন্তরে মহাপ্রভুকে ভোগ খাওয়ানোর ইচ্ছে রেখেছিলেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি অনশন করে নিজের প্রাণ বিসর্জন করবেন বলে ঠিক করেন। তখনই তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন স্বয়ং জগন্নাথদেব। মাহেশে এসে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি গড়ে ভোগ খাওয়ানোর নির্দেশ দেন। চৈতন্যের সমসাময়িক জনৈক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী পুরী গিয়ে জগন্নাথ বিগ্রহ দর্শন করে প্রীত হয়ে মাহেশের গঙ্গাতীরে এক কুটিরে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ স্থাপন করেন। পরে শেওড়াফুলির জমিদার মনোহর রায় সেখানে প্রথম একটি মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন।
মাহেশে রথযাত্রার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ১৩৯৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। পুরীর পর দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় প্রাচীন রথ হল মাহেশের এই রথ। মাহেশের বর্তমান রথটি প্রায় ১২৯ বছরের পুরনো। জানা যায়, ১৭৫৪ সালে হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণরাম বসু পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট কাঠের রথ তৈরি করেন। সেই রথ জীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ১৭৯৮ সালে তাঁরই বংশধর গুরুপ্রসাদ বসু নয় চূড়া বিশিষ্ট নতুন রথ তৈরি করেন। এরপর ১৮৮৪ সালে একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রথটি ভস্মীভূত হয়ে যায়। তখন ওই বসু পরিবারেরই কৃষচন্দ্র বসু ফের এই রথ তৈরির উদ্যোগ নেন। বার বার আগুনে পুড়ে রথ নষ্ট হওয়া আটকাতে বিশ্বম্ভরের ছোট ভাই কৃষ্ণচন্দ্র বসু ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে ১২৫ টন ওজনের পঞ্চাশ ফুট উঁচু এক বিশাল রথ নির্মাণ করিয়ে দেন। মার্টন বার্ন কোম্পানির দায়িত্বে গড়ে ওঠে এই রথ। আর সে রথের নকশা করেন ভারতের প্রথম পাশ্চাত্যধারার স্থপতি নীলমণি মিত্র।
মাহেশের রথের ওজন প্রায় ১২৫ টন। উচ্চতা ৫০ ফুট। ৯টি চূড়া বিশিষ্ট এই রথটিতে মোট ১২টি লোহার চাকা রয়েছে। রয়েছে ২টি তামার ঘোড়া। যে ২টি রথটিকে টানে। একটি নীল ও অন্যটি সাদা। থাকে কাঠের সারথি দুটি রাজহাঁস। করোনার কারণে গত ২ বছর রথের মেলা ও মাহেশের রথের উত্সব স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এবার সেই বাধা আর নেই। তাই লক্ষাধিক ভক্তের সমাগমে আশঙ্কা করছেন কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৮দিন ধরে চলে রথের মেলার উত্সব। রথের দিন শ্রীরামপুরের গোপীনাথ মন্দিরে মাসির বাড়িতে যাত্রা করে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। দূর-দূরান্ত থেকে এখনও বহু মানুষ আসেন। পুলিশের হিসেব অনুযায়ী প্রতি বছর লক্ষাধিক ভক্ত এই রথ দেখতে আসেন। জগন্নাথ মন্দির থেকে রথ জি টি রোড ধরে দেড় কিলোমিটার পথ পেড়িয়ে পাড়ি দেয় মাসির বাড়ি অর্থাৎ শ্রীরামপুরের গোপীনাথ মন্দির।