মুম্বই: আজ যে রাজা, কাল সে ফকির… এই কথাটি নির্মম হলেও সত্যি। কালের স্রোতে হারিয়ে যায় অনেক প্রতিভা। ভাগ্যের পরিহাসে জীবনের গতিপথ বদলে যায়। খ্যাতির চূড়ার কাছে পৌঁছে গিয়েও শূন্য হতে হয়। ক্রিকেট কাউকে অনেক কিছু দেয়, তো কেউ আবার যোগ্য সুযোগটুকুও পান না। সচিন তেন্ডুলকর (Sachin Tendulkar) যে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন, তা হয়তো রমাকান্ত আচরেকর (Ramakant Achrekar) না থাকলে হত না। কথায় বলে জহুরি হিরে চেনে… ঠিক তেমনটাই হয়েছিল স্যার আচরেকরের সঙ্গে। সচিন যে ক্রিকেটের বিস্ময় বালক, তা আচরেকর বেশ আচ করেছিলেন। তবে সচিনের উত্থানের ঠিক আগে, আচরেকরের অন্যতম প্রিয় ছাত্র ছিলেন অনিল গুরব (Anil Gurav)। যার কথা অনেক ক্রিকেট প্রেমীই হয়তো জানেন না। কি নামটা মনে পড়েছে? না পড়তেই পারে। সচিনের আগে আচরেকরের অন্যতম প্রিয় শিষ্য অনিল গুরবকে নিয়ে রইল কিছু তথ্য TV9Bangla-র এই প্রতিবেদনে।
সচিন তখন বয়সে অনেকটাই ছোট, অনুশীলন করেন রমাকান্ত আচরেকরের কাছে। সেই সময় মুম্বইয়ে ক্রিকেট জগতে অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম ছিল অনিল গুরব। মুম্বইয়ের যেখানে যে ম্যাচই হত না কেন, চারিদিক মুখরিত থাকত অনিল গুরবের নামে। ভাবা যায়! যে মুম্বই সাক্ষী থেকে সচিন… সচিন… গর্জনের সেই মুম্বইতে তাঁর আগে বন্দনা হত অনিল গুরবের। একটা সময় গুরু আচরেকর দুই শিষ্য সচিন তেন্ডুলকর ও বিনোদ কাম্বলিকে বলেছিলেন, ক্রিকেটে উন্নতি করতে হলে তাঁরা যেন অনিল গুরবকে দেখে শেখে।
দ্য ভিভ রিচার্ডস অফ মুম্বই বলা হত অনিল গুরবকে। সেখান থেকে বস্তির মাতাল হয়ে ওঠেন অনিল। বাইশ গজে বোলারদের দুরন্ত বাউন্সারকে শাসন করা থেকে ভাগ্যের পরিহাসে হাজতবাসও করতে হয়েছে অনিলকে। অভাবের সংসারে অনিলের মায়ের অবস্থা ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরনোর মতো। দুই ছেলের পড়াশুনোর খরচ যোগান দিতে হিমশিম খেতে হত অনিলের মাকে। তাও তিনি মুম্বইয়ের কোচ রমাকান্ত আচরেকরের কাছে ক্রিকেট তালিম নেওয়ার জন্য পাঠান অনিলকে। তাঁর মধ্যে যে প্রতিভা ছিল, তা ঘষেমেজে নেন আচরেকর। তার পর থেকে পাড়ার ক্রিকেট থেকে শুরু করে স্কুল ক্রিকেটে একটাই নামের স্লোগান চলত — অনিল… অনিল… গুরব… গুরব…
স্কুল ক্রিকেটে অনিল রীতিমতো সেঞ্চুরির ঝড় তুলতেন। মুম্বইয়ের বয়সভিত্তিক দলে একের পর এক রেকর্ডও গড়েছিলেন। জোরে বোলারদেরও নাকানি চোবানি খাওয়াতে ওস্তাদ ছিলেন তিনি। তাঁর মতো খুব কম ক্রিকেটারই ছিলেন যাঁরা বাউন্সার হুক করা, প্রতিটা শট দক্ষতার সঙ্গে খেলতে পারতেন। তবে নির্বাচকদের সামনে তিনি সেই অর্থে নজর কাড়তে পারেননি। সচিনের উত্থানের ঠিক আগের সময়টাতে, আশির দশকে অনিলের উৎসাহী ভক্তদের মধ্যে ছিলেন সচিন এবং বিনোদ কাম্বলি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাঁরা প্রায়শই নেটে গুরবের ব্যাটিং দেখতেন। সচিন-কাম্বলিকে তাঁর থেকে শেখার কথা বলেছিলেন আচরেকর। যা নিয়ে গুরব বলেন, “সচিন আমার কাট এবং হুক শট পছন্দ করতেন। তিনি আমার থেকে শক্তি দিয়ে খেলার বিষয়ে কিছু টিপসও নিয়েছিলেন।”
যাঁকে সামনে থেকে দেখে নকল করতেন সচিন, আজ সে কোথায় আর সচিন কোথায় দাঁড়িয়ে? ভাবতেই অবাক লাগে। সিনিয়র হওয়ার ফলে সচিন সেই সময় গুরবকে ডাকতেন ‘স্যার’ বলে। কাম্বলিও স্যার বলতেন। শুধু তাই নয়, গুরবের ব্যাট ব্যাবহার করার খুব ইচ্ছে হত সচিনের। কিন্তু লাজুক সচিন নিজে কখনও তা অনিলকে বলতে পারেননি। সেই সময় সচিনের এই ইচ্ছের ব্যাপারে ক্রিকেটার রমেশ পরব জানিয়েছিলেন গুরবকে। এর পর সেদিনই অনিল ডেকে পাঠান সচিনকে। তার পর সচিনকে ডেকে নিজের হাতে ব্যাট দিয়ে বলেছিলেন, ‘একটাই শর্তে এই ব্যাট দিচ্ছি, খুব বড় ইনিংস খেলতে হবে’। সেই ম্যাচে শতরান করে সচিন কথা রেখেছিলেন। তবে অনিলকে ফেরত দেননি তাঁর ব্যাটটি।
গুরব বেশিদিন ক্রিকেট জগতের আলোয় থাকতে পারেননি। যখন এক দিকে অনিল বাইশ গজে ব্যাট হাতে বোলারদের শাসন করতে ব্যস্ত, তখন তাঁর ছোট ভাই অজিত বন্দুক হাতে মুম্বই শাসন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। ভাগ্য মোড় নিতে বেশি দেরি করেনি। এক দিকে অনিল ক্রিকেটে ভালো সুযোগের খোঁজ করতে থাকেন, তো অন্য দিকে অজিত অপরাধ জগতের সঙ্গে যোগসূত্র আরও বাড়াতে থাকেন।
মাঝে মধ্যেই ভাইয়ের খোঁজ করতে বাড়িতে আসা পুলিশের পিটুনির শিকার হতে হত অনিল ও তাঁর মাকে। একটা সময় পুলিশ অনিলকে মেরে পা ভেঙে দিয়েছিল। সেই সময় ভালো ক্রিকেট খেলার সুবাদে অনিল আশা করেছিলেন, ক্রিকেট জগত থেকে তাঁকে উদ্ধারের জন্য কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেন। আদতে যা হয়নি। এরপরই হতাশা গ্রাস করে অনিলকে। নেশা করা শুরু করেন। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে অনিল পুলিশকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, তাঁর ও তাঁর মায়ের সঙ্গে অজিতের কোনও সম্পর্ক নেই। এর পর থেকে পুলিশি উৎপাত কমতে থাকে। তবে অনিলের আর ক্রিকেটে ফেরা হয়নি। তিনি এখন মুম্বইয়ের বস্তি নালাসুপারাতে থাকেন। বাড়ির রং দেওয়াল থেকে খসে খসে পড়েছে। হাড় গিলগিলে শরীরের দশা। কে বলবে, এই মানুষটাকে একটা সময় নকল করার চেষ্টা করতেন সচিন?