ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। এই শব্দবন্ধটা শুনলেই বিদ্যুতের মতো শিহরণ খেলে যায় শরীরে। গোটা দেশ চার দেওয়ালে আটকে পড়ে, রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যায়, গ্যালারি উপচে পড়ে। আর ভারত-বাংলাদেশ! পশ্চিমের প্রতিবেশীর জন্য সুর যতটা সপ্তমে ওঠে পূর্বের প্রতিবেশীর জন্য ততটাই খাদে। সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ে বাংলাদেশকে কখনওই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসাবে ধরা হয় না। এবার কিন্তু পরিস্থিতি অন্য। ভারত-বাংলাদেশ টেস্ট নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে কতটা উৎসাহ কাজ করছে জানা নেই, কিন্তু বাংলাদেশিরা আগ্নেয়গিরির মুখে দাঁড়িয়ে। প্রেস্টিজ ফাইট তাদের কাছে। ‘আহত বাঘের’ মতো মুখিয়ে রয়েছে শিকার ছিনিয়ে আনার। কারণ একটাই। তাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের আশ্রয়ে। শেখ হাসিনার ঘাড়ে ঝুলছে অপহরণ-খুনের একাধিক মামলা। তাঁকে দেশে ফেরাতে মরিয়া মহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভারত বিরোধী বিদ্বেষ দেখা দিয়েছে বাংলাদেশিদের মনে। এই আবহে কয়েক যোজন স্নায়ুর চাপ নিয়ে ভারতে খেলতে আসছেন সাকিব আল হাসান-লিটনরা। সেই চাপ রাখতে পারবে? নিজের দেশ খেলতে আসায় কতটা বিড়ম্বনায় হাসিনা? প্রশ্ন অনেক। উত্তর…চলুন দেখা যাক।
বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। এর নেপথ্যে ভারতের অবদান কারও অজানা নয়। তবে এখন পরিস্থিতি অন্য। বাংলাদেশ ‘নতুন’ স্বাধীনতার খোঁজে। প্রসঙ্গ যখন, ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট, সেখানেই না হয় ঢোকা যাক। সেখানে ঢুকতে গেলেও অবশ্য স্বাধীনতার প্রসঙ্গ তুলতেই হবে। টেস্ট স্বাধীনতা। বাংলাদেশের টেস্ট স্টেটাস পাওয়ার লড়াইটাও সংক্ষিপ্ত ছিল না। সেই প্রচেষ্টা চলছিল দীর্ঘদিন। আর সেই স্বাধীনতাও ভারতের অবদান রয়েছে। হঠাৎ কেন টেস্ট ক্রিকেট এবং বাংলাদেশ নিয়ে এত আলোচনা! সামনেই ভারত-বাংলাদেশ দু-ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ এই দু-ম্যাচ। আর এ বার যেন অন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম নামতে চলেছে। সেটা নানা আঙ্গিকেই। এর জন্য গভীরে ঢোকা প্রয়োজন। তা হলে শুরু থেকে শুরু করা যাক।
একটা সময় অবধি বাংলাদেশেও প্রিয় এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। ৯-এর দশকের শেষের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে থাকে। ফুটবলকে ছাপিয়ে যেতে থাকে ক্রিকেট। কিন্তু সাফল্য ছাড়া জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখা কঠিন। ক্রিকেটে তাঁদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ ১৯৮৬ সালে। প্রতিটি ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে টেস্ট খেলার। দেশেরও। কিন্তু টেস্ট স্টেটাস পাওয়ার জন্য এমন কিছু করে দেখাতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার কাছে দাবি জানানো যায়। বাংলাদেশের কাছে সেই মুহূর্তে তেমন কিছুই ছিল না, যা নিয়ে টেস্ট স্টেটাসের জন্য লড়াই করা যায়। আইসিসি ট্রফিতে লাগাতার ব্যর্থতার জেরে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে থাকে।
কাট টু ১৯৯৬। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে এক নতুন কমিটি। প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে সাবের হোসেন চৌধুরি। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে সাবের জানিয়েছিলেন, বোর্ড সভাপতি হিসেবে তাঁর প্রথম মিটিংয়েই যে ভিশন তুলে ধরেছিলেন, তাতে ছিল-‘ব্যতিক্রমী কিছু করতে হবে।’ তাঁদের লক্ষ্য ছিল টেস্ট স্বীকৃতি। আইসিসির টেস্ট স্টেটাস হাতের মোয়া নয় যে চাইলেই পাওয়া যাবে। এর জন্য অনেক শর্তাবলী প্রযোজ্য। সেই সব শর্তপূরণের পরিস্থিতি ছিল না বাংলাদেশের। সে সময় বাংলাদেশের সঙ্গে একই স্বপ্ন দেখছিল জিম্বাবোয়ে।
সে সময় বাংলাদেশের এক প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক সে দেশের ক্রিকেট পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছিলেন, ‘নবম টেস্টের অপেক্ষায়’। অর্থাৎ নবম দেশ হিসেবে আইসিসির টেস্ট স্বীকৃতি পাওয়াই লক্ষ্য। তৎকালীন বিসিবি ডিরেক্টর আহমেদ সাজ্জাদুল ববি এবং প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন, তোড়জোড় শুরু করেন। যদিও বিসিবি ডিরেক্টরের কাছে সে সময় সাবেরের ভিশন-বাস্তব মনে হয়নি। কারণ, তার জন্য সাফল্য প্রয়োজন ছিল। বিসিবি প্রেসিডেন্ট আইসিসির কাছে টেস্ট স্বীকৃতির আবেদন করতেই এক প্রাক্তন ক্রিকেটার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এটা কি মজার ব্যাপার নাকি? কখনও সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশের পালে কিছুটা হাওয়া দেয় ১৯৯৭ সালে কুয়ালামপুরে আয়োজিত আইসিসি ট্রফি। খেতাব জিতেছিল বাংলাদেশ। তার আগে ওডিআই খেললেও, আইসিসির স্টেটাস ছিল না। সহযোগী দেশ হিসেবেই খেলত বাংলাদেশ। অবশেষে ১৯৯৭ সালে ওডিআই স্টেটাস দেয় আইসিসি। একটা ট্রফি জিতলেও টেস্ট ক্রিকেটের জন্য যে যথেষ্ট ছিল না, সেটাও ভাবনায় ছিল। বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবের পথ দেখিয়েছিলেন এই বাংলারই একজন।
সে সময় আইসিসি সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া। ভারতের প্রথম ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে যিনি আইসিসির সর্বোচ্চ পদে বসেছিলেন। জগমোহন ডালমিয়া যে এই বাংলারই মানুষ। তাঁকে বিসিবি কর্তারা পরিস্থিতি বোঝান। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়, ১৯৯৯ সালে ওডিআই বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন। বাংলাদেশের সমর্থনে ছিলেন প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া। বিসিবি সচিব সৈয়দ আশরাফুল হক এবং প্রেসিডেন্ট সাবেরকে পথ দেখান জগমোহন ডালমিয়া। আশরাফুল এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘সাবের চেয়েছিল আইসিসি মিটিংয়ে ভোটিংয়ের জন্য। তবে জগ্গু দা (জগমোহন ডালমিয়া) পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেটা ভালো আইডিয়া নয়। কারণ, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার সমর্থনই নিশ্চিত ছিল। ফলে অন্যান্য ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গেও যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছিলেন।’ শেষ অবধি জগমোহন ডালমিয়ার সময়েই টেস্ট স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ।
স্বীকৃতি তো মিলল, এ বার টেস্ট? টেস্ট অভিষেক ধূমধাম হওয়া চাই। এর জন্য পাশে চাই সরকারকেও। বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেক হয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধেই। টেস্ট স্টেটাস পাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন ভারতের ভূমিকা ছিল, তেমনই আরও একজনের কথা ভুললে চলবে না। তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্তা সাবেরই জানিয়েছিলেন, ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পুরো দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সাবের নিজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমস্ত বিষয় জানান যে বাংলাদেশ একটা ঐতিহাসিক সাফল্যের পথে রয়েছে। অবশেষে ২০০০ সালে ঢাকায় ভারতের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্ট।
এক পাশে সৌরভ, আর এক পাশে দুর্জয়, মাঝে শেখ হাসিনা। শুরু হল বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন অধ্যায়। শুধু বাংলাদেশের টেস্ট জন্মের ম্যাচেই নয়, সে দেশের অনেক ম্যাচেই স্টেডিয়ামে পা রেখেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১১ বিশ্বকাপে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ সহ এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। কাকতলীয় হলেও, ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের শেষ টেস্টেও কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। সামনে আরও একটা ভারত-বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজ। ভারতের মাটিতে খেলা, শেখ হাসিনাও ভারতেই। কিন্তু কোথায়! কেউ জানে না। আপাতত কোনটা তাঁর দেশ, সেটাও যেন…।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঐতিহাসিক মুহূর্ত স্মরণীয় করে রাখতে কোনও ত্রুটি রাখেনি তারা। ক্রিকেটপ্রেমীদের উন্মাদনা ছিল দেখার মতো। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে সিট না পাওয়ার আশঙ্কায় স্টেডিয়ামের বাথরুমেও রাত কাটিয়েছেন অনেক ক্রিকেট প্রেমী। যাতে সকালে দ্রুত গ্যালারিতে জায়গা দখল করতে পারেন। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর সেই ম্যাচও শুরু হয়েছিল শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই। ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশ অধিনায়ক নৈমুর রহমান (যাঁর ডাক নাম দুর্জয়), মধ্যমণি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐতিহাসিক সেই টেস্টে ভারত জিতলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল আমিনুল ইসলামের সেঞ্চুরি এবং হাবিবুল বাশারের ৭১ রানের ইনিংস।
সেই থেকে টেস্টে ভারত-বাংলাদেশ ১৩ বার মুখোমুখি হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য আনলাকি থার্টিন। ১১টি ম্যাচ জিতেছে ভারত। বাকি দুটি নিষ্ফলা। ভারত বেশ কয়েকবার টেস্ট খেলতে বাংলাদেশ গেলেও ভারতের মাটিতে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলার সুযোগ পায় ২০১৭ সালে। হায়দরাবাদে সেই ঐতিহাসিক টেস্ট হয়েছিল। এরপর ২০১৯-২০ মরসুম। ভারতের মাটিতে দু-ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে এসেছিল বাংলাদেশ। ইন্দোরে প্রথম টেস্ট। আগ্রহ ছিল বেশি দ্বিতীয় টেস্ট ঘিরে। ভারতের প্রথম পিঙ্ক-বল টেস্ট ছিল সেটি। ইডেন গার্ডেন্সে সেই ম্যাচ হয়েছিল। দেশের প্রথম গোলাপি বলে দিন-রাতের টেস্ট ঘিরে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এবং বাংলা ক্রিকেট সংস্থা ব্যাপক আয়োজন করেছিল।
আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ হিসেবে ভারতে দু-ম্যাচের সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ। কিন্তু এ যেন অন্য বাংলাদেশ টিম! রাজনৈতিক দিক থেকে এবং পারফরম্যান্সেও। এত দিন ভারত-বাংলাদেশ যত টেস্ট খেলেছে, এই সময়কালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে ছিলেন শেখ হাসিনা। এই প্রথম ভারতের বিরুদ্ধে তাঁকে ‘ছাড়া’ টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম। খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। সরকার বিরোধী আন্দোলনে জ্বলছিল বাংলাদেশ। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়তে হয় শেখ হাসিনাকে। আশ্রয় নেন ভারতেই। কিন্তু তিনি ভারতের কোথায় রয়েছেন, তা প্রকাশ্যে আনা হয়নি।
এ দিক থেকে, ভারতের প্রতি বাংলাদেশের একটা বিরোধী মনোভাব রয়েইছে। আর ক্রিকেট মাঠে ভারত-বাংলাদেশ বরাবরই আবেগের লড়াই চলে। সমর্থকদের জন্য আরও বেশি। ক্রিকেটে ভারতকে হারাতে পারলে বাংলাদেশের সমর্থকরা বন্য আনন্দে ভাসেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় কমেন্টের লড়াই। সেই সুযোগ যদিও খুব একটা আসে না। এ বার নতুন স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমীরা।
সদ্য পাকিস্তান সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্রথম বার টেস্ট জয়ের স্বাদ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের মাটিতে তাদেরই ক্লিনসুইপ করেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘প্রথম’ জয়ের পর নজরে এ বার ভারত। সঙ্গে শেখ হাসিনা পর্ব তো রয়েইছে। শেখ হাসিনা ভারতে আসার পর থেকেই বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের মধ্যে ভারত-বিরোধী মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার ছাপ পড়তে পারে ক্রিকেট মাঠেও। ভারত-বাংলাদেশ এই সিরিজ সে কারণেই আরও অনেক অনেক বেশি উপভোগ্য হতে চলেছে। লড়াইটা যে শুধু ব্যাটে-বলে নয়…।