অভিষেক সেনগুপ্ত
মুম্বই: সকাল হলেই ফেরিঘাট জমজমাট। একঝলক দেখলে বাবুঘাট মনে হবে। কিচিরমিচির ভাষা। ছত্রপতি শিবাজী স্টেশন থেকে গাড়ি-বাস বোঝাই মানুষ নামছেন গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া দেখতে। লঞ্চ পারাপার থেকে স্টিমার রাইড, কী নেই সুখ-সন্ধানে। দিনের দখল যদি কোলাবার থাকে, সন্ধে নামলে আবার অন্য রং মেরিন ড্রাইভে। সি-লিঙ্ক পর্যন্ত মানুষের ঢল। পারিবারিক উৎসবে, বন্ধুদের রিইউনিয়নে, প্রেমের উত্তাপ নিতে সারা মুম্বই যেন নেমে পড়ে পায়ে পায়ে। দেখলে বিশ্বাসই হবে না, কোলাবা থেকে মাইল দুয়েক দূরে, মেরিন ড্রাইভ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে এত বড় একটা ম্যাচ পসরা সাজিয়ে বসছে!
বিয়ে বাড়ির মতো ঝিকমিকে আলোর রোশনাই, জলধোয়া রাস্তা আর কৌতুহলী মুখের আনাগোনা। তফাত তবু থেকে যায়। উত্তাপের গহ্বরে ঢোকার আগে রোমাঞ্চের খোঁজ পাওয়া বড় মুশকিল। ইডেন হলে বলতে হত না। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু কিংবা দেশের অন্য বড় স্টেডিয়াম হলেও তাই। যেন কোনও এক পাড়ার পেটে লুকিয়ে রয়েছে আস্ত একটা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ওয়াংখেড়ে এমনই। হৃদয়ের কেন্দ্রে বাস ক্রিকেটের। উঠোন পেরোলেই যেন ছোঁয়া যায় বাইশ গজ! দীপাবলির রোশনাই এখনও ফিকে হয়নি মুম্বইয়ে। কমেনি আতসবাজির দাপটও। দিওয়ালি উদযাপনে মুম্বইয়ে এক আতঙ্কের রেকর্ড করে বসেছে। বাজির শব্দব্রহ্ম ছাপিয়ে গিয়েছে ১১৫ ডেসিবল। উদ্বেগের কথা তো বটেই। কিন্তু বুধবারের জনউল্লাস, বিপক্ষের উইকেট পতনের গণচিৎকার সেই উল্লাসকে ছাপিয়ে যাবে না, গ্যারান্টি কোথায়?
না, গ্যারান্টি নেই। যেমন ওয়াংখেড়ে গ্যারান্টি দিতে পারছে না, আর একটা একপেশে ম্যাচ হবে না! মুম্বইয়ের বিশ্বকাপজয়ী স্টেডিয়ামের বাইশ গজের মন-মর্জি বোঝা বড় দায়। টস জিতে ব্যাট নেওয়া নিশ্চিন্ত করতে পারে। কে বলতে পারে, তাতেও বিপদের গন্ধ থাকবে না। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আগের দিন রোহিত শর্মা জোর দিয়ে বলে গেলেন, টস ফ্যাক্টর হবে না। এই মাঠে অগুনতি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা থেকে। কিন্তু্ রোহিত মনের কথা বললেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। নিউজিল্যান্ডের ক্যাপ্টেন কিন্তু আলগোছে স্বীকার করে নিলেন সত্যিটা। ওয়াংখেড়ে যতটুকু চেনেন কেন উইলিয়ামসন, জানেন টস জেতাই সবচেয়ে নিরাপদ এবং প্রাথমিক পদক্ষেপ।
টস, টস আর টস! এর বাইরে কি আর কিছুই নেই? আছে তো! গ্রুপ লিগে ভারত-শ্রীলঙ্কার সেই ম্যাচ এখনও ভোলেনি মুম্বই। ভারতের বিপুল রান তাড়া করতে নেমে মাত্র ৫৮তে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল লঙ্কানরা। আবার এই মাঠেই কয়েক দিন আগে অতিমানবিক ইনিংস খেলে গিয়েছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। সম্ভাবনার দুই মুখই খোলা রাখছে ওয়াংখেড়ে। আর সেই দুটো মুখই দখলে নিতে চান রোহিত শর্মা। বিরাট কোহলি দুরন্ত ফর্মে। রোহিত নিজেও ছন্দে। শ্রেয়স আইয়ার, লোকেশ রাহুলরাও বিশ্বাস আর ভরসার সর্বোচ্চ শিখরে বসে। বুমরা-সামি-সিরাজদের ধারালো বোলিংও থাকবে স্টার্টার কিংবা ডেজ়ার্ট হিসেবে। সঙ্গত করবেন জাডেজা-কুলদীপ। এমন আগ্রাসী ভারতকে সামলাতে পারবে নিউজিল্যান্ড?
৭০ বছর আগের এক গল্প হঠাৎই ভেসে উঠল ওয়াংখেড়েতে। ১৯৫৩ সালের এক মে মাসে তেনজিং নোরগেকে সঙ্গে নিয়ে এভারেস্টের মাথায় চড়ে বসেছিলেন নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী এডমন্ড হিলারি। কেন উইলিয়ামসনদের তিনিও যেন এভারেস্টে ওঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। গত পাঁচ-সাত বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল টিমের নাম নিউজিল্যান্ড। আইসিসির টুর্নামেন্টে শেষ চারে ওঠাটা অভ্যেস করে ফেলেছেন কিউয়িরা। এমন ধারাবাহিক টিম তবু কাপের ছায়ায় থেকে গিয়েছে বরাবর। চেষ্টা-স্বপ্ন-তাগিদ আছে, কিন্তু ফিনিশিং নেই। সাদা বলের ক্রিকেটে এ বার সেই আক্ষেপ ঝেড়ে ফেলে পোডিয়ামে উঠে দাঁড়াতে চাইছেন রাচিন রবীন্দ্র, ট্রেন্ট বোল্টরা। পারবেন?
এই প্রশ্নের অবকাশই থাকবে। আলবাৎ থাকবে। ভারতের আগুনে ফর্মের জন্যই থাকবে। নয়ে-৯ কি সোজা কথা? যে টিম গ্রুপ লিগে অপরাজিত, তারা তো অল-উইন বিশ্বকাপ চাইবেই। রোহিত কিন্তু এই প্রশ্নে হাসলেন। আসলে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন নিজেকে। টিমকে। সব তুলে রেখেছেন চব্বিশ ঘণ্টা পরের সেমিফাইনালের জন্য। চার বছর আগের বিশ্বকাপ হারের ক্ষত যে এখনও শুকোয়নি। বদলার গন্ধ মম করছে ওয়াংখেড়েতে!