অভিষেক সেনগুপ্ত
ভারত ১৫১-৭ (২০ ওভারে)
পাকিস্তান ১৫২-০ (১৭.৫ ওভারে)
১৯৯২ সালে যে বার বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান (Pakistan), বাবর আজমের (Babar Azam) বয়স কত ছিল? আরও দু’বছর পর পৃথিবীর আলো দেখবেন তিনি! তাঁর সঙ্গী ওপেনার মহম্মদ রিজওয়ান জন্মাবেন মাসতিনেক পর!
১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে আমির সোহেল আর ভেঙ্কটেশ প্রসাদের সেই বিখ্যাত ঝামেলার সময় কত বয়স ছিল বাবর ও রিজওয়ানের। যথাক্রমে ২ ও ৪ বছরের শিশু! ২০১৬ সালে ইডেনে ভারতের কাছে জঘন্য হেরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ার সময়ও টিমে ঢোকেননি কেউই। আসবেন, আর কয়েক মাস পরে। শুধু বাবর, রিজওয়ান নন, যে টিমের অধিকাংশ ক্রিকেটার পাক-বিপর্যয় দেখেননি, চোখের জলে ভেঙে পড়তে দেখেননি, বিতর্কে ফালাফালা হননি, সেই টিমই বিশ্বকাপের যাবতীয় গ্লানি আপাতত মুছে দিল। ওয়ান ডে বিশ্বকাপে ৭বার হার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আরও ৫। সব মিলিয়ে বারোটা ম্যাচ হারের পর ‘আরও তেরো’র স্বপ্ন দেখছিলেন যাঁরা, তাঁদের থামিয়ে দিয়ে সবুজ-বিপ্লব দেখালেন বাবর-শাহিন আফ্রিদিরা। এতটা যে, পাকিস্তানের দাপটে দাঁড়াতেই পারল না বিরাট কোহলির ভারত।
কিছু ম্যাচ এমনও হয়, যেখানে একটা টিমই যাবতীয় আস্ফালন দেখায়। বিশ্বকাপে এতদিন ভারতীয় টিম পাকিস্তানকে পেলে এভাবেই উড়িয়ে দিত। এই প্রথম রংবদল দেখল ক্রিকেট দুনিয়া। দুবাইয়ের উইকেটে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রিন আর্মিরই দাপট। ভারতের ১৫১-৭ ১৩ বল বাকি থাকতেই তুলে দিল পাকিস্তান। তার থেকেও যেটা বড়, সেটা হল, সামি-বুমরারা একটা উইকেটও ফেলতে পারলেন না বিপক্ষের!
১৫২ দুবাইয়ের উইকেটে কখনওই কঠিন ছিল না। সেটা আরও সহজ করে দিলেন বাবর ও রিজওয়ান। ৫৫ বলে ৭৯ করে নট আউট থেকে গেলেন রিজওয়ান। ৫২ বলে নট আউট ৬৮ বাবরের। এত সাবলীল, এত ছন্দময় ব্যাটিং শেষ কবে পাকিস্তান টিম তুলে ধরতে পেরেছে, মনে পড়ছে না। সামির মতো অভিজ্ঞ, বুমরার মতো ঝাঁঝালো, বরুণ চক্রবর্তীর মতো রহস্যময় স্পিনারও দাগ কাটতে পারলেন না। হয়, এক-এক দিন এমনও হয়! যে দিন বিপক্ষ মাঠে ছিল, মনেই হয় না!
শেষটা যদি বাবর-রিজওয়ানের হয়, শুরুটা ছিল শাহিন আফ্রিদির। অফ-মিডলে পড়ে ইষৎ লাফানো বল। চকিৎ বাঁক নিয়ে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে ঢুকে যাওয়া। নয়ের দশকে এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যেত। সবুজ জার্সি পরা এক বাঁ হাতি তখন দাপিয়ে বেড়াতেন বাইশ গজে। বিপর্যয়ে পড়ে ব্যাটাররাই দিয়েছিলেন ডাকনাম— সুইংয়ের সুলতান!
ওয়াসিম আক্রমের পর পাক টিমে সুইংয়ের আর এক জাদুকরের দেখা মিলল— শাহিন আফ্রিদি। সেই আক্রমের মতো ছোট অথচ নিয়ন্ত্রিত সুইং। হঠাৎ বাঁক নিয়ে প্যাড কিংবা উইকেট খুঁজে নেওয়া। পাওয়ার প্লে-তে শাহিন এমন সাইন করলেন যে, ঘোর কাটতে না কাটতে ২-৬! দুই ওপেনার রোহিত শর্মা (০) ও লোকেশ রাহুল (৩) ড্রেসিংরুমে। ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের ম্যাচে এমন ঝড় আক্রমও তোলেননি কখনও! ম্যাচ শেষের বোলিং বিশ্লেষণ যদি ধরা হয়, ৪-০-৩১-৩! ঝুলিতে বিরাট কোহলি নামক সুপারস্টারের উইকেটও শাহিনের।
টি-টোয়েন্টিতে বিপক্ষকে চাপে রাখার জন্য ঠিক কত রান দরকার পড়ে? মাঠ, পিচ কুড়ি-বিশের ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। শারজায় লো স্কোর ম্যাচ, আবার দুবাইয়ে সেটা হাইস্কোর। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ মুঠোয় রাখতে হলে ভারতের দরকার ছিল ১৭০-১৮০র মতো রান। কিন্তু বিরাট কোহলির টিম থামল ১৫১-৭-এ। দুই ওপেনার ৬ রানের মাথায় ফিরে গেলে এমনই হয়। তবু এই ধাক্কা সামলে দিলেন বিরাট একাই। ৫৭ রানের চমৎকার ইনিংস খেলে গেলেন। ৪৯ বলে ৫টা চার ও ১টা ছয় দিয়ে সাজালেন ইনিংস। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরই অধিনায়কত্ব ছাড়বেন, ঘোষণা করে দিয়েছেন। এই বিশ্বকাপটা জিততে তিনি কতটা মরিয়া, তারই ছাপ রেখে গেলেন। বিরাটের মতো তাগিদ যদি আর কেউ দেখাতে পারতেন।
কিংবা ঋষভ পন্থ হতে পারতেন কেউ! গত দেড় বছরে পন্থ ভারতীয় টিমকে অনেক বড় ম্যাচে টেনেছেন। ক্যাপ্টেন হিসেবে দিল্লিকে তুলেছিলেন প্লে-অফে। পাক ম্যাচেও চেনা পন্থকেই দেখা গেল। ৩০ বলে ছটফটে ৩৯ করলেন পন্থ। আর একটু থাকতে পারলে ১৮০-র স্বপ্ন দেখতে পারত ভারত। পন্থ এমনই। কিন্তু বাকিরা? সূর্যকুমার যাদব চার নম্বরে নামলে ঠিক কী ভূমিকা পালন করা দরকার, তা বোধহয় বুঝতে পারেননি। নাকি, পাকিস্তান ম্যাচের চাপ নিতে পারলেন না। শেষ দিকে রবীন্দ্র জাডেজা (১৩) ফিরতেই হার্দিক পান্ডিয়াও দ্রুত আউট।
১) রবি শাস্ত্রীর টিম ম্যানেজমেন্ট হার্দিককে কেন খেলালেন, সেটাই স্পষ্ট নয়। ৬ কিংবা ৭ নম্বরে নেমে ১০-১২ বলে ২০-২৫ করবেন বলেই তো। পুরনো হার্দিক আর এই হার্দিকে অনেক ফারাক। তাঁর বদলে শার্দূল ঠাকুরকে খেলানো উচিত।
২) সূর্যর থেকে টিমে ঈশাণ কিষাণকে খেলানো উচিত ছিল। আইপিএলের শেষ দিকে দুরন্ত ফর্মে ছিলেন। ওয়ার্মআপ ম্যাচেও ভালো খেলেছেন। রোহিতের সঙ্গে রাহুলকে ওপেন করিয়ে ঈশাণকে তিনে খেলানো যেতে পারে। সেই সঙ্গে কিন্তু শ্রেয়স আইয়ারের টিমে জায়গা না-পাওয়াটা ফের বিতর্কের চেহারা নেবে।
৩) বরুণ চক্রবর্তী আইপিএলের এক-আধটা ম্যাচ ছাড়া তেমন খেলতে পারেননি। রহস্যময় স্পিনার যতই বলা হোক, বারব আজম, মহম্মদ রিজওয়ানদের তাঁকে পড়তে কোনও অসুবিধাই হয়নি। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের অভিজ্ঞতা এই ম্যাচে কাজে লাগাত পারত টিম ম্যানেজমেন্ট।
৪) আরও একবার প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে বিশ্বকাপে ভারতের টিম নির্বাচন নিয়ে। আইপিএলের সেরা স্পিনার যুজবেন্দ্র চাহালকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তারই খেসারত দিতে হচ্ছে। এমনকি, ভুবনেশ্বর কুমারের ধার-ভার দুই-ই কমেছে। হর্ষল প্যাটেলের টিমে জায়গা পাওয়া উচিত ছিল।
ভারত-পাকিস্তান (India vs Pakistan) ম্যাচ চিরকাল বিতর্কের জন্ম দেয়। ওয়াঘার এপারে যেমন, ওপারেও তেমন। পাঁচ বছর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেমে বিরাট কোহলির টিম এতদিনের তৃপ্তিকে যন্ত্রণায় বদলে দিলেন। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই পাক-ধাক্কায় কিন্তু রাস্তা হারাতে পারে শাস্ত্রীর টিম!
ভারত এখন বিতর্কের আগ্নেয়গিরিতে। আর পাকিস্তান, ২৮ বছর পর সুখের রাত নেমেছে ওয়াঘার ওপারে!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: ভারত ১৫১-৭ (বিরাট ৫৭, পন্থ ৩৯, জাডেজা ১৩, শাহিন ৩-৩৩, হাসান ২-৪৪)। পাকিস্তান ১৫২-০ (রিজওয়ান নট আউট ৭৯, বাবর নট আউট ৬৮)।