আলো আর অন্ধকার, দুই-ই পা মেলায় ইতিহাসের মিছিলে। উজ্জ্বলতম অতীত যেমন ফিরে আসে স্মৃতিতে, তেমনই চুপিসারে হানা দেয় কলঙ্কও। ক্রিকেট ইতিহাস যেমন রেকর্ড, সাফল্য, নায়কদের খোঁজ দেয়, তুলে ধরে বিতর্কিত ঘটনাও। ক্রিকেট ইতিহাসের মহাবিতর্কিত নানা গল্পের খোঁজ দিল TV9 Bangla। দীপঙ্কর ঘোষাল তুলে ধরলেন দশম কিস্তি।
পাপ-পূণ্য পুরোটাই বিশ্বাস। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু… প্রবাদ হলেও অবাস্তব নয়। অন্তত দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে। হ্যান্সি ক্রোনিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা চরিত্র। তাঁর যাবতীয় কৃতিত্ব ঢাকা পড়ে গিয়েছে গড়াপেটার কেলেঙ্কারিতে। রামধনুর দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্রিকেটে প্রচুর ওঠানামা রয়েছে তাদের। ক্রোনিয়েকে ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট অসম্পূর্ণ। তাঁর নেতৃত্বে দারুণ রেকর্ড রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার। ২০০৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রেটেস্ট ক্রিকেটার নির্বাচিত হন ক্রোনিয়ে। তার আগে ম্যাচ গড়াপেটার জন্য ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত ছিলেন। একদা নায়ক, হয়ে গিয়েছিলেন খলনায়ক। সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি প্লেন দুর্ঘটনায়। মাত্র ৩২ বছর বয়সে।
লোভ বড় বালাই। ক্রোনিয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ২০০০ সালে প্রকাশ্যে আসে ঘটনা। নেতৃত্ব যায় ক্রোনিয়ের। চিরনির্বাসনের কবলে পড়েন। বুকিদের থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকারও করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘লোভ এবং বোকামির কবলে পড়েছিলাম। সহজেই অর্থ উপার্জনের লোভ কলঙ্কের গাড্ডায় ঠেলে দিয়েছিল। সেখান থেকে বেরোনো কষ্টকর ছিল।’ কেপটাউনের কোর্টরুমে কান্নায় ভেঙে পড়া ক্রোনিয়ের কলঙ্কিত অধ্যায়ের শুরুটা কোথায়?
১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাস। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে। ম্যাচ ছাড়ার জন্য প্রায় ৮ লক্ষ টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয় ক্রোনিয়েকে। প্রস্তাব ফেরান দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক। টাকার অঙ্কটা মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারেনি। অর্থ বাড়ে, ধরিয়ে দেয় লোভও। ১৯৯৬ সালে ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট। ভারত অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিন বুকি মুকেশ গুপ্তার সঙ্গে পরিচয় করান ক্রোনিয়ের। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য ২৪ লক্ষ টাকা প্রস্তাব দেওয়া হয়। ভারতের বিরুদ্ধে টেস্টের শেষ দিন হারতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। দলকে এই বার্তা দিতে পারেননি ক্রোনিয়ে। টাকা নিলেও ম্যাচটি শেষ অবধি লড়াই করেই হারে প্রোটিয়ারা। ক্রোনিয়ে নিজেও পরে বলেছিলেন, ‘কিছু না করার জন্যও টাকা নিয়েছিলাম।’
ঠিক-ভুল যেভাবেই দেখা হোক। টাকা নিয়েছিলেন, সেটাও অপরাধ। একবার নয়, অনেক বারই। ভারত সফরে ওয়ান ডে সিরিজে। শেষ ম্যাচ যে জিতবে সিরিজ তাদের। বুকিদের কাছে এর চেয়ে সেরা সুযোগ হয় না। ম্যাচ হারার জন্য ক্রোনিয়েকে ভারতীয় অঙ্কে ২০ কোটির মতো প্রস্তাব দেওয়া হয়। দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেন অধিনায়ক ক্রোনিয়ে। নিজেই জানিয়েছিলেন সে কথা। ‘ম্যাচের আগে সন্ধ্যায় সমস্ত ক্রিকেটারদের নিয়ে আলোচনায় বসি। দলকে প্রস্তাবের বিষয়ে জানাই। সকলেই মানা করে। পুরো দলের সঙ্গে মিটিয়ের পরও কয়েকজন ছিল। আরও একবার আলোচনা হয়। প্রস্তাবের অঙ্কটা বাড়ানো যায় কী না, সেই দিকটা ভেবে দেখছিলাম,’ জানিয়েছিলেন ক্রোনিয়ে।
প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও দলের সমর্থন হারান অধিনায়ক ক্রোনিয়ে। সারা বিশ্বের চোখেও নেমে গিয়েছিলেন। তাঁকে সন্দেহের উর্ধ্বে রাখা যায়নি। মৃত্যু না হলে ক্রোনিয়েকে এখনও হয়তো সেই জ্বালা বয়ে বেড়াতে হত। জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে ২৭টি টেস্ট এবং ৯৯টি ওয়ান ডে ম্যাচে জয়। ৬৮ টেস্টে ৩৭১৪ রান, ওয়ান ডে তে সাড়ে পাঁচ হাজার রান, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮টি শতরান, ১৫৭ উইকেট। সব হারিয়ে গিয়েছে গড়াপেটার পর্দার আড়ালে। ২০০২ সালে প্লেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাঁর। কোর্টের তরফে জানানো হয়েছিল, পাইলটের ভুলেই দুর্ঘটনা।
কিছু ভুল তবু স্বস্তি দেয়। কিছু ভুল পেয়ে যায় মার্জনাও। হ্যান্সি ক্রোনিয়ে হয়তো স্বস্তি আর ক্ষমা দুই-ই পেয়েছেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়ে।