T20 World Cup 2021: ডি’ককের ‘দুঃসাহস’ ও ওয়াকারের ‘চতুরতার’ কাহিনি

TV9 Bangla Digital | Edited By: সঙ্ঘমিত্রা চক্রবর্ত্তী

Oct 28, 2021 | 8:38 PM

গত কয়েকদিনে বিশ্ব ক্রিকেটে দুঃসাহসী ও গোঁড়ামির ঘটনা ঘটেছে। প্রথম ঘটনাটি দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটকিপার কুইন্টন ডি'ককে নিয়ে এবং অন্যটি পাকিস্তানের অন্যতম সেরা পেস বোলার ওয়াকার ইউনিসের সাথে সম্পর্কিত।

T20 World Cup 2021: ডিককের দুঃসাহস ও ওয়াকারের চতুরতার কাহিনি
T20 World Cup 2021: ডি'ককের 'দুঃসাহস' ও ওয়াকারের 'চতুরতার' কাহিনি

Follow Us

শৈলেশ চতুর্বেদী

টি-২০ বিশ্বকাপে (T20 World Cup) ভারত-পাকিস্তান (India vs Pakistan) ম্যাচের পর পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার ওয়াকার ইউনিস (Waqar Younis) যে কুসংস্কারের প্রদর্শন করেছিলেন তা কিন্তু নতুন ঘটনা নয়। তিনি তাঁর সতীর্থ ইমরান খানের দেখানো পথই অনুসরণ করছিলেন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা ক্রিকেটার কুইন্টন ডি’ককের (Quinton de Kock) নেওয়া সিদ্ধান্ত তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারের জন্য বেশ মারাত্মক প্রমাণিত হতে পারে।

সাহসিকতার তিনটি রূপ রয়েছে: একটি সাহস, অন্যটি সাহসিকতা এবং তৃতীয়টি হল চিনি মেশানো ধর্মের নামে গোঁড়ামি। সময়, অবস্থা এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে, কেউ কেউ এই ধর্মান্ধতাকে বোকা হিসাবে আখ্যায়িত করবে, অন্যরা এটিকে ধূর্ত বলবে আবার একটি নির্দিষ্ট অংশ এটিকে সাহসের শিখরে পৌঁছে যাওয়াও মনে করতে পারে। গত কয়েকদিনে দুঃসাহসী ও গোঁড়ামির ঘটনা ঘটেছে। প্রথম ঘটনাটি দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটকিপার কুইন্টন ডি’ককে নিয়ে এবং অন্যটি পাকিস্তানের অন্যতম সেরা পেস বোলার ওয়াকার ইউনিসের সাথে সম্পর্কিত।

যদিও ওয়াকার বর্তমানে আর পেশাদার ক্রিকেট খেলেন না, সম্প্রতি তিনি একটি পাকিস্তানি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে আলোচনা চলাকালীন, ওয়াকার মন্তব্য করেছিলেন যে মহম্মদ রিজওয়ান ‘হিন্দুদের মধ্যে মাঠে নামাজ পড়ে’ একটি দুর্দান্ত কাজ করেছেন। তাঁর বক্তব্য আরও চমকপ্রদ মনে হয়, যখন কেউ এটা তুলে ধরে যে ওয়াকার ইউনিস পাকিস্তান ক্রিকেটের শিক্ষিত অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

ইমরানের দেখানো পথ অনুসরণ করছেন ওয়াকার

কিন্তু ওয়াকার ভালো মতোই বোঝেন যে শ্রোতারা তাঁর কথা ভালো করে শোনে। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অনুকরণ করছেন, যিনি রাজনীতিতে যাওয়ার পর থেকে ঠিক একই কাজ করছেন। তাঁর সারা জীবন ধরে, ইমরান খানকে একজন ‘উদারপন্থী’ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু পরে, তিনি একটি ইসলামিক কট্টরপন্থী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। একই পথ ধরে ওয়াকারও এগিয়ে চলেছেন এবং তাঁর নির্লজ্জ কথাকে বলা যেতে পারে চিনিমাখানো সাহসী গোঁড়ামি। সম্ভবত ওয়াকার বুঝতে পেরেছেন কী কী বক্তব্য তাঁকে খবরের শিরোনামে রাখবে, আমাদের দেশের সব টিভি প্যানেলিস্টের কাছেই এটা জানা, এবং এটা একটা খোলা রহস্য। আর এই কাজটাই তিনি করেছেন।

এই বিষয়গুলি উপেক্ষা করা সহজ নাও হতে পারে, তবে এই সব করা খেলাধুলার স্বার্থে। একজন ক্রীড়াবিদ হিসাবে তাঁর খেলার সময়, ওয়াকার কখনও মাঠে নামাজ পড়ার কথা উল্লেখ করেননি। এখন অবসর নেওয়ার পর তিনি যেন অন্য ‘খেলায়’ কেরিয়ার গড়ার চেষ্টা করছেন। যদিও তিনি একটি টুইটের মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছেন, শুধুমাত্র তিনিই তাঁর ক্ষমা চাওয়ার সত্যতা জানেন, কারণ আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে কেউ এই ধরনের শব্দ উচ্চারণ করেন না।

কুইন্টন ডি ককের সিদ্ধান্ত সাহসী

ওয়াকারের ঘটনা থেকেও ডি’ককের সাহসী সিদ্ধান্ত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডি’কক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জন্য প্রতিবাদে সামিল হওয়া ‘হাঁটু মুড়ে বসার’ পরিবর্তে দলের বাইরে থাকা বেছে নিয়েছিলেন। কুইন্টন ডি’ককের এই সিদ্ধান্ত তাঁর কেরিয়ারের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, আজকের বিশ্বে বর্ণবাদের কোনও স্থান নেই। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকায়, যেখানে এটি নির্মূল করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও যদি এই ধরণের কোনও ঘটনা ঘটে থাকে, তা হলে বিষয়টির গোড়া থেকে অনুসন্ধান করা দরকার। ডি’কক বরাবরই এ ধরনের বিষয়ের বিরোধিতা করেছেন। তিনি মনে করেন যে বাক স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার, যদিও লোকেরা তাঁর কথাগুলোকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করতে পারে। তিনি একই ধরণের কাজ করছেন। ডি’ককের কথাগুলোকে সাহসী হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বর্ণবাদ থেকে কত দূর এগিয়েছে?

প্রথমত, আমাদের দক্ষিণ আফ্রিকাকে বুঝতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বর্ণবাদ নিয়ে চর্চা হয়ে আসছে। গোটা বিশ্ব দক্ষিণ আফ্রিকাকে ক্রীড়ার আধিপত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। তারা ১৯৯১-৯২ সাল থেকে ক্রিকেট খেলা শুরু করে। ধারণা করা হয়েছিল যে তারা বর্ণবাদ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করে দেখার যোগ্য। ১৯৯৪ সালের পর প্রায় ৬৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেট খেলেছে, যারা দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, যদিও তাঁরা জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ।

সম্প্রতি, জাতিসংঘ কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে, মাত্র ৮ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী স্কুলে খেলাধুলার সুযোগ পায়। এর মাধ্যমে বর্ণবাদের ভয়াবহ বাস্তবতা কল্পনা করা যায়। এই বৈষম্য দূর করতে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের জন্য কোটা বরাদ্দ করা হয়। এক মরসুমে বিভিন্ন ব্যাক্তির রংয়ের কিংবা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ছটি কোটা বরাদ্দ করা হয়। যার মধ্যে অবশ্যই তিনজনে কৃষ্ণাঙ্গ হতে হবে। ২০২২-২৩ সাল থেকে এই কোটা বাড়িয়ে সাতটি করা হবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কোটা বৃদ্ধির ফলে প্রতি ম্যাচে কৃষ্ণাঙ্গদের অংশগ্রহণ ৩৩ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কোটা বনাম মেধা

এই কোটার নিয়মেকে কেন্দ্র করেই সব বিতর্ক। এমনকি আমাদের দেশেও দলিত অধিকার নিয়ে বিতর্ক চলছে। ভারতীয় খেলাধুলায় কোটা ব্যবস্থা নেই। সরকারি চাকরি সংক্রান্ত আলোচনার সময় এই বিতর্কগুলি প্রায়ই সীমা ছাড়িয়ে যায়। এটা সত্যি যে দেশগুলির মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু একটি সমস্যা বোঝার জন্য আমরা একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি সহজ করতে পারি।

কোটা বনাম মেধা নিয়ে বিতর্ক এখন চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। দক্ষিণ আফ্রিকাতেও সেটাই হচ্ছে। বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়দের যুক্তি যে নির্বাচন হওয়া উচিত যোগ্যতার ভিত্তিতে। তারা সুবিধামত ভুলে যায় ৫০ বছরের নিপীড়নের কথা। কিছু কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের যুক্তি ভিন্ন হলেও এই বিতর্কের পক্ষেই। ফাস্ট বোলার মাখায়া এনটিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা নিষিদ্ধ বিষয় হয়ে উঠেছে। তাদের বাছাই করা হয় কোটার ভিত্তিতে, মেধার ভিত্তিতে নয়। এখন আপনি ভারতের একটি উদাহরণ দিয়ে এটি বুঝতে পারবেন।

আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন যে কোটা পদ্ধতির কারণে একজন বিশেষ ব্যক্তি চাকরি পেয়েছেন বা কোনও ব্যাক্তির পদোন্নতি হয়েছে। এটি এমন খেলোয়াড়দের জন্য সমস্যা তৈরি করে যারা নিছক যোগ্যতার ভিত্তিতে দলে নিজেদের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। এটা বোঝার জন্য, ভারতীয় ক্রিকেট দলে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এর পরিণতি কী হবে বলে আপনি মনে করেন? সৌভাগ্যবশত, ভারতে এই ধরণের কিছুই ঘটেনি এবং ঘটবে বলে আশা করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যখন ডি’ককের মতো শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়রা দাবি করেন তাঁদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। এনটিনির মতো খেলোয়াড়রা বলেছেন যে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দলে জায়গা পাওয়া সত্ত্বেও তাঁদের সম্মান দেওয়া হয় না। এই সব ক্ষেত্রে কী করা উচিত?

এনটিনি এবং পল অ্যাডামসের অস্বস্তি

এনটিনি বলেছেন যে, তিনি দল থেকে আলাদা অনুভব করেন। পল অ্যাডামস একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করেছেন যে, তাঁকে ‘হোহা’ বলা হয়েছিল, যার অর্থ একটি ড্রেনের পোকার্ম। স্পষ্টতই, একজন শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়কে ড্রেনের পোকা হিসাবে উল্লেখ করা হবে না। দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ের প্রায় সব কৃষ্ণাঙ্গ প্লেয়ারদের গল্প একই রকম। এই বৈষম্যের মধ্যে কোটা ব্যবস্থা কি আসলেই পরিস্থিতির পরিবর্তন আনার সঠিক উপায়?

এমনকি ভারতেও, অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন যে সমাজের বঞ্চিত অংশগুলিকে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম দেওয়া উচিত যেখানে তারা বাকিদের সাথে সমানভাবে দাঁড়াতে পারে। এর জন্য শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। শৈশবে এমন সব সুযোগ পাওয়া উচিত যা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত লোকেরা পায়। এর পরের সব কিছু সিদ্ধান্ত মেধার ভিত্তিতে নিতে হবে। কিন্তু এই ধরনের লাইন লেখা সহজ। বাস্তবে এমনটা হয় না। অন্যদিকে যেখানে কোটা ব্যবস্থা থাকবে সেখানেই বিরোধিতা থাকবে, সেটাই হচ্ছে। ডি’কক যা করেছেন তা কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু এর বিরোধিতা করার সময় দক্ষিণ আফ্রিকার উন্নয়নের কথা মাথায় রাখতে হবে। ঘটনাটি প্রথমে দেখলে যতটা সহজ মনে হয় ঠিক ততটাও সহজ নয়।

Next Article