তিথিমালা মাজী
কলকাতার বেলেঘাটা থেকে কাতারের দূরত্ব কতটা? বিমানে কিংবা গুগল ম্যাপ দূরত্ব যাই বলুক, মনের দূরত্ব নেই। টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা মোবাইল অ্যাপে ম্যাচ দেখতে দেখতেও যেন অনেকের মনে হয়, কয়েক হাতের দূরত্বেই তো খেলা হচ্ছে! রিচার্লিসনের গোল কিংবা রোনাল্ডোর সেই পরিচিত সেলিব্রেশন দেখে মনে হয়, সবই চোখের খুব কাছেই ঘটছে। আর যিনি সশরীরে ফুটবলের এই মহযজ্ঞের মাঝে উপস্থিত রয়েছেন? এমনই একজনের কথা তুলে ধরল TV9Bangla। পুরোটা পড়লে হয়তো আপনারও অনুভূতি আরও গাঢ় হতে পারে যে, আপনিও কাতারেই রয়েছেন।
ফুটবল বিশ্বকাপের মতো বড় আসর। হাজার হাজার মানুষের কোলাহল, হইচই। আট থেকে দশ ঘণ্টার শিফ্ট সামলানোর ফাঁকে ফোনে বলে উঠলেন, “দয়া করে বাংলার বর্তমান প্রজন্মের কাছে আমার মেসেজ পৌঁছে দেবেন।” কলকাতার বেলেঘাটার বাসিন্দা শুভাশীষ নাথ। গত চারবছর তাঁর ঠিকানা কাতার। ওখানকার একটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ান। বছরে নিয়ম করে কলকাতায় আসা। ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে। আর ফুটবল প্রিয় বাঙালি বিশ্বকাপ থেকে দূরে সরে থাকবেনই বা কী করে! ফুটবলের সবচেয়ে বড় উৎসবকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন শুভাশীষ। কাতার বিশ্বকাপে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন বেলেঘাটার শুভাশীষ। ফিফার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে তাঁর। কাতার বিশ্বকাপে ভলান্টিয়ারের জন্য ২০৯টি দেশ থেকে মোট ৪ লাখ ২০ হাজার আবেদন পড়েছিল। তার মধ্যে ৫৮ হাজার ইন্টারভিউয়ের সুযোগ পান। সেখান থেকে কীভাবে সুযোগ এল শুভাশীষের কাছে?
কোভিডের সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল স্কুল। দিনের বেশিরভাগ সময় নেট সার্ফিং করেই কাটাতেন শুভাশীষ। আন্তর্জালে দুনিয়ায় একদিন ফিফার স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার আবেদন পাঠিয়ে দেন। সাক্ষাৎকারের পর ট্রায়াল, শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা-সহ বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোনোর পর বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন ৪২ বছরের শুভাশীষ। ২০২১ সালে প্রথম কাজ ফিফা আরব কাপে। বর্তমানে স্কুল বন্ধ। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দিনে আট থেকে দশ ঘণ্টা করে বিশ্বকাপে ডিউটি করছেন বিভিন্ন স্টেডিয়ামে। আল বায়াত স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। লুসেইল স্টেডিয়ামে সৌদি আরবের কাছে মেসিদের হার দেখেছেন খুব কাছ থেকে। কী কী দায়িত্ব পালন করতে হয়? টিকিট বিক্রি থেকে হসপিটালিটি, বহু রকমের কাজে যুক্ত। আট থেকে দশ ঘণ্টার শিফ্ট। ডিউটি শুরু হওয়ার চার ঘণ্টা আগে রিপোর্টিং। সব ক্লান্তি পুষিয়ে যায় সুন্দর ফুটবলে।
এই কাতারের মাটিতেই ঘটে গিয়েছে সৌদি বিপ্লব। লক্ষ্য করেছেন, আর্জেন্টিনাকে হারানোর পর সৌদি আরবের ম্যাচের টিকিটের চাহিদা বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। দলে দলে সৌদি থেকে সমর্থকরা আসছেন দেশের ফুটবলারদের সমর্থন জানাতে। মেক্সিক্যান সমর্থকদেরও ভিড় প্রচুর। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার সমর্থকরা তো বিশ্বকাপ শুরুর বহু আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন।
ফুটবল বিশ্বকাপের হপ্তা পার হতে চলল। একাধিক অঘটন, সমকামিতা নিয়ে দেশটির মনোভাবের সমালোচনা, ইরানিয়ানদের প্রতিবাদ, বিশ্বকাপ কতটা বদলে দিতে পারল রক্ষণশীল কাতারকে? বিতর্কে ঢুকতে চান না। বললেন, “প্রচুর ধনী এই দেশ। খুব কম মানুষকে দেখেছি হেঁটে যাতায়াত করতে। অথচ এই বিশ্বকাপের সময় সব বদলে গিয়েছে। ধনী, গরীব নির্বিশেষে কাতারে কাতারে মানুষ পথে নেমে পড়েছেন। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।”
আপাতত বিজয়ী দশমী নিয়ে ভাবতে চান না। কার হাতে কাপ উঠবে, কার হবে বিসর্জন, সবই তাঁর ভাবনার বাইরে। দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফুটবলেই মোহিত হয়ে থাকতে চান।