রিও ডি জেনেইরো: ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত সরকারে থাকাকালীন স্বৈরশাসক হিসেবে কুখ্যাত হয়েছিলেন ভার্গাস। ব্রাজিলের রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনে ছিল তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব। এমন পরিস্থিতিতে নিজের অফিসেই আত্মহননের পথ বেছে নেন। ব্রাজিলবাসীর মনোবল তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল। সে বছরই স্যান্টোসের হয়ে অভিষেক ঘটে পেলের। একেবারে প্যান্ডেমোনিয়াম অবস্থা।
ভার্গাসের মৃত্যুর দু’বছর পর ব্রাজিলে নতুন সরকারের আগমন হয়েছে। সালটা ১৯৫৬। চারিদিকে পরিবর্তনের হাওয়া। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট পদে জুসেলিনো কাবিশেক সবেমাত্র গেতুলিও ভার্গাসের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। নতুন কিছু করে দেখানোর উদ্যম, ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি, দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল বদলে দেওয়ার ভাবনা। পাঁচ বছরের মেয়াদে ৫০ বছরের উন্নতির কথা বলছেন নতুন প্রেসিডেন্ট। বিভিন্ন সাহসী পদক্ষেপের ঝুলি নিয়ে প্রেসিডেন্ট অফিসে পা দেন। পাঁচ বছরের মেয়াদে ব্রাজিলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং গড় ব্রাজিলিয়ান শ্রমিকদের ভালো জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে তাঁর অবদান ছিল। মেয়াদের শেষদিকে ব্রাজিলের শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল ৮০ শতাংশ। তবে জুসেলিনো সরকারের সময়ে মুদ্রাস্ফীতিও ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এই সত্যটি জুসেলিনো সরকারের বিরোধীরা বারবার উত্থাপন করেছে। ফল ১৯৬১ সালে জুসেলিনোকে সরিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে বসেন জানিও কুয়াদ্রোস। তার আগেই ১৯৫০ সালের মারাকানাজোর ব্যথা ভুলিয়ে দিয়েছেন পেলে। প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপ এসেছে ব্রাজিলের ঝুলিতে। চারিদিকে পেলেকে নিয়ে হইচই।
চার বছরের মধ্যে স্যান্টোসের হয়ে ২১০ ম্যাচে ২৩০ গোল। ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলির মধ্যে পেলেকে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পেলেকে বের করে আনার মরিয়া প্রচেষ্টা। ব্রাজিলিয়ান সংবাদমাধ্যমগুলির শিরোনামে দেখা গেল, পেলেকে রিলিজ করে দেওয়ার জন্য স্যান্টোসের কাছে বিপুল অর্থের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। দলগুলির নাম হল ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান। প্রমাদ গুণতে শুরু করেছেন ব্রাজিলিয়ানরা। স্যান্টোস মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে সাময়িক স্বস্তি দিলেও, পুরোপুরি স্বস্তি কোথায়? স্যান্টোসের কাছে পাত্তা না পেয়ে ক্লাবগুলি ব্যক্তিগতভাবে পেলের কাছে প্রস্তাব পাঠাতে শুরু করে। ব্রাজিলিয়ানদের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। এই বুঝি ইউরোপের কোনও দল পেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল!
প্রেসিডেন্ট অফিসে বসে সব খবরই পাচ্ছিলেন জানিও কুয়াদ্রোস। তাঁর মাথায় তখন রাজনৈতিক কূটবুদ্ধি খেলছে। পেলেকে সামনে রেখে ব্রাজিলিয়ানদের মন জয় করে গদি বাঁচানোর ফন্দি আঁটলেন। কারণ ততদিনে কুয়াদ্রোসের জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে পৌঁছেছে। তার পিছনে ছিল একটি প্রধান কারণ। ব্রাজিলকে বলা হয় বিচের দেশ। অথচ রিও ডি জেনেইরোর বিচগুলিতে মেয়েদের, বিকিনির মতো স্বল্প পোশাক পরা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। খুব তুচ্ছ কারণ মনে হলেও সেই সময় অত্যন্ত বিতর্ক খাড়া করেছিল এই নিয়ম। এরই মাঝে পেলে ইউরোপে চলে গেলে কুয়াদ্রোসের গদি বাঁচানোর কোনও উপায়ই থাকবে না। কারণ, ব্রাজিলিয়ানদের কাছে পেলে একজন ফুটবলারের চেয়েও আরও অনেক বেশি কিছু। কুয়াদ্রোস জানতেন, পেলে ইউরোপে পাড়ি দিলেই কোপ পড়বে তাঁর উপর। রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার তাগিদেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন কুয়াদ্রোস। তড়িঘড়ি পেলেকে ‘জাতীয় সম্পদ’ ঘোষণা করে পার্লামেন্টে বিল পাস করান। যাতে বিশাল সম্মান দেওয়ার পাশাপাশি পেলেকে ব্রাজিলের ক্লাবেই রাখা যায়।
নিজের স্বার্থের কথা ভাবলেও কুয়াদ্রোসের কৌশলে সবদিক বজায় থেকেছিল। পেলের কল্যাণে বহুকাঙ্খিত ব্রাজিলের জনগণের সমর্থন পেয়েছিলেন কুয়াদ্রোস। স্যান্টোস এমন একজন ফুটবলারকে পেয়ে গিয়েছিল যিনি হাসতে হাসতে গোল করতে পারেন। পেলের জন্য আরও এক দশক নিজের জন্মভূমিতে থাকার সুযোগ।