কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায়
আজও পাঁচটা ঘণ্টা বরাদ্দ রেখেছেন নিজের জন্য। দুপুর গড়ালেই কিট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঠিক বেরিয়ে পড়েন। টলি ক্লাব (Tollygunge Club) কিংবা ক্যালকাটা ক্লাবের (Calcutta Club) উদ্দেশে। এই তিনিই আবার আটপৌঢ়ে গৃহিনী। স্বামী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঘোর সংসারী। বয়স কারও কারও কাছে নেহাতই পুরনো ক্যালেন্ডার। বহু ব্যবহারে ক্লিশে সেই শব্দবন্ধনী রাখতে হচ্ছে ৬১ বছরের মহিলার জন্য, যিনি রাঁধেন, তিনি চুলও বাঁধেন। নীতা কোঠারির (Neeta Kothari) ক্ষেত্রে বলতে হবে, যিনি রাঁধেন, তিনি রাজ্য চ্যাম্পিয়নও হন!
কোঠারি পরিবার মানে বিলিয়ার্ডসের নানা গল্প। সেই মনোজ কোঠারি (Manoj Kothari) থেকে যে স্রোত বয়ে এসেছে সৌরভ কোঠারিতে (Sourav Kothari)। সেই পরিবার যিনি বেঁধে রেখেছেন, তিনি বিলিয়ার্ডস (Billiards) খেলবেন না হয় নাকি! এবং এমনই খেলেন নীতা, আজও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বাংলায়। প্রশ্ন করা হল, কতবার রাজ্য চ্যাম্পিয়ন আপনি? মনে করতে পারলেন না। একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘সেই ২০০২ সাল থেকে খেলছি। এত বার রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হয়েছি যে, সংখ্যাটা আর মনে নেই। তবে ২০১৯-এ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আবার হলাম।’ মাঝের একটা বছর যদি কোভিডের কারণে রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপ বন্ধ না থাকত, তাহলে নীতার মনে না পড়ার সংখ্যা আরও বাড়ত।
ফাইনালে সুচেতনা মোহান্তকে স্ট্রেট গেমে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন নীতা। খেলার ফল ৭৫-১৮, ৭৫-৫৮। স্কোরলাইনেই পরিষ্কার নীতাকে সামলানোর মতো প্লেয়ার এখনও বাংলায় উঠে আসেনি। এতে শেষ নয়, এই একষট্টিতেও জাতীয় ব়্যাঙ্কিং প্লেয়ার তিনি।
কী ভাবে বিলিয়ার্ডসে এলেন? ফোনের ওপার থেকে টিভি নাইন বাংলাকে নীতা শোনালেন ২০ বছর আগের গল্প। ‘মেয়ে তখন ছোট। এক বিকেলে ক্যালকাটা ক্লাবে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ভুল করে বিলিয়ার্ডস রুমে ঢুকে পড়ি। মনোজ তখন শহরের বাইরে। আমাকে বিলিয়ার্ডস রুমে ঢুকতে দেখে মাস্টার বলেছিল, ম্যাডাম একটা শট মেরে দেখুন না। দোনোমনো করে শট নিয়েছিলাম। তখনই বোধহয় প্রেমে পড়ে যাই। সেই যে শুরু করেছি, আজও আমার সঙ্গী কিউ।’
২০ বছরের কেরিয়ারে প্রচুর সাফল্য। এমনও হয়েছে, কোঠারি পরিবারের ৪ সদস্যই জাতীয় মিটে নেমেছেন। এমনও হয়েছে, মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশেও গিয়েছেন টুর্নামেন্ট খেলতে। কখনও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন না হতে পারলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছেন। ২০১৪ সালে লিডসে বিশ্ব মিটে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন। ওই বিশ্ব মিটেই মায়ের মতো ছেলেও পেয়েছিলেন ব্রোঞ্জ। অর্ধেক পৃথিবী নীতা ঘুরে বেড়িয়েছেন শুধু বিলিয়ার্ডসের টানে।
নীতা বলছিলেন, ‘আমি সব অর্থে গৃহবধূ। আগে সংসার, তারপর বিলিয়ার্ডস। মনোজ যখন টুর্নামেন্ট খেলতে বাইরে যেত, আমি একা হতে সংসার সামলেছি। আবার আমি যাতে ভালো খেলতে পারি, তার জন্য মনোজ প্রচুর উত্সাহও দিয়েছে। সত্যি বলতে কি, ওরা আমার পাশে না থাকলে এই বয়সে আর বিলিয়ার্ডস খেলা হত না।’
এই ৬১-তেও বহু বহুদিনের অপূর্ণ স্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ‘২০ বছর ধরে খেলছি। কিন্তু কখনও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। এটা একদিকে যেমন আক্ষেপ, অন্যদিকে একটা স্বপ্নও। ওই স্বপ্ন আমি একদিন ছুঁয়ে দেখতে চাই। সেই টানে আজও বিলিয়ার্ডস বোর্ডে নেমে পড়ি।’
কিছু গল্প থাকে যা রূপকথা হয়ে যায়। কিছু প্লেয়ার থাকেন, যাঁরা কিংবদন্তি হয়ে যান। জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হোন আর নাই হোন, নীতার বিলিয়ার্ডস যাত্রা যেমন রূপকথা তিনিও তেমনি কিংবদন্তি!
আরও পড়ুন: Simone Biles: টোকিও অলিম্পিকের আগেই জিমন্যাস্টিক্স ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল, বলছেন বাইলস