বাঁকুড়া, হুগলি ও আরামবাগ: রান্নার গ্যাসের দাম আকাশ ছোঁয়া। ঘরোয়া সিলিন্ডার পিছু দাম হাজার টাকা পেরিয়েছে। আর এরই মধ্যে দুর্মূল্য হয়ে উঠছে স্টোভের কেরোসিনও। অগত্যা রান্নার জ্বালানি হিসাবে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের ভরসা কাঠ ও কয়লার গুঁড়ো। এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের একাধিক জেলায় পাল্লায় দিয়ে বাড়ছে কেরোসিনের দামও। বাঁকুড়ার এখন লিটার পিছু কেরোসিন তেলের দাম আশি থেকে নব্বই টাকা। আজ থেকে এক দশক আগেও বাঁকুড়া শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের কাছে রান্নার জ্বালানি হিসাবে দেদার ব্যবহার করতে দেখা যেত কাঠ ও কয়লার গুঁড়ো থেকে হাতে পাকানো গুল। কিন্তু ধীরে ধীরে কেরোসিনের স্টোভ ও পরবর্তীতে উজালা যোজনার হাত ধরে গ্যাস হাতে পাওয়ায় নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির কাছে কার্যত ইতিহাস হয়ে যেতে বসেছিল কাঠ ও গুলের উনুন। কিন্তু রান্নার গ্যাসের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ঘটতে ঘটতে এখন সিলিন্ডার পিছু দাম দাঁড়িয়েছে ১০২৬ টাকা।
এই পরিস্থিতিতে গ্যাস কিনতে না পেরে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ ব্যবহার শুরু করেছিলেন কেরোসিনের স্টোভ। কিন্তু এখন কেরোসিনের দামও বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গিয়েছে লিটার পিছু আশি থেকে নব্বই টাকা। অগত্যা গ্যাস ও স্টোভ মাচায় তুলে ফের কাঠ কয়লা ও কয়লা গুঁড়ো দিয়ে হাতে পাকানো গুলের উনুন ফিরেছে বাঁকুড়ার দিন আনা, দিন খাওয়া পরিবারগুলিতে। সেখানেও দেখা দিয়েছে সমস্যা। গত কয়েক দশকে বাঁকুড়া শহর কলেবরে অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় কার্যত উধাও হয়ে যেতে বসেছে জঙ্গল। তাই মিলছে না জ্বালানির জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত কাঠও।
এই চিত্র শুধু বাঁকুড়ায় নয়। জেলায় জেলায় একই ছবি। কেরোসিনের দাম বাড়ার ফলে নাজেহাল অবস্থা চাষিদের। কারণ গৃহস্থের বাড়িতে এখন আর ততটা কেরোসিন ব্যবহার হয় না। মূলত চাষের সেচের কাজেই বেশি ব্যবহার হয় কেরোসিন তেল। একসময় যেখানে বছরে বিঘা প্রতি সেচের জন্য কেরোসিন খরচ হত ৫০০-৭৫০ টাকার, এখন সেই খরচ বছরে বিঘা প্রতি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার টাকার কাছাকাছি। একদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বার বার ফসল নষ্টের ফলে ফলন কমেছে। বার বার লোকসানের মুখে পড়ছেন চাষিরা। অন্যদিকে ফসলের বীজ থেকে সারের দামও বাড়ছে হুহু করে। এর মধ্যে এখন আবার সেচের খরচও দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা কৃষকদের।
এদিকে কেরোসিন ডিলারদের একাংশের বক্তব্য, কমিশনের পরিমাণ একই আছে। কিন্তু বেড়েছে বিনিয়োগের পরিমাণ। ফলে কেরোসিন ডিলারদের অবস্থাও এক প্রকার নাজেহাল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কৃষক এবং কেরোসিন ডিলার… সবাই তাকিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে। আরামবাগের কেরোসিন ডিলারদের কেউ কেউ আবার বলছেন, কেরোসিনের অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধিতে কেরোসিন তেল অনেকেই নিতে আসছেন না। কাঠ পাতার জ্বালানিতে ধোয়া যুক্ত কাঠের উনুনে চলছে রান্নাবান্না।
আর কতদিন এভাবে রান্নাবান্না চালাতে পারবেন সেই নিয়েই চিন্তায় রয়েছেন আরামবাগের আশে পাশের এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামগুলির মানুষজন। কারণ, পর্যাপ্ত পরিমাণে জ্বালানি কাঠ অমিল। বাধ্য হয়েই গ্রামের মানুষজন বনে জঙ্গলে জ্বালানির খোঁজে পাতা ঝাঁট দিচ্ছেন। ঝরে পড়া কিছু গাছের ডালকে বাড়িতে নিয়ে এসে শুকনো করে জ্বালানির সন্ধান করে নিচ্ছেন মানুষজন। কেউ কেউ মাঠে গোবর কুড়িয়ে এনে শুকনো করে জ্বালানি ব্যবহার করছেন। কিন্তু এভাবে কতদিন? কবে মিলবে সমাধান? সেই উত্তরের আশায় দিন কাটছে জেলাগুলির মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি।