বীরভূম: সিঙ্গুরের মতো জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হবে না, দেউচা পাচামি প্রকল্পের প্যাকেজ ঘোষণা করতে গিয়ে এ কথা আগেই জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকেই পাচামি এলাকায় খনি প্রকল্পের কাজে তত্পর হয়েছে প্রশাসন। পাচামি এলাকার আদিবাসীদেরও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে এ কথাও জানিয়েছে রাজ্য সরকার (State Government)। এরপর পাচামি এলাকায় পরিদর্শনে যান বাম নেতা (CPM) সুজন চক্রবর্তী। আর সেখানেই তৃণমূল কর্মী (TMC) সমর্থকদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন বলে অভিযোগ।
সুজন এদিন বলেন, “সাধারণ মানুষ কী চাইছেন, আদৌ তাঁরা এই প্রকল্প চাইছেন কি না, তাঁদের কোনও ক্ষতি হবে কি না এই সব খতিয়ে দেখতেই আমরা আজ এখানে এসেছিলাম। কেন আমরা যেতে পারব না! পাচামি প্রকল্প কি কেবল তৃণমূলের নাকি! এটা তো রাজ্য সরকারের প্রকল্প। আমরা এখানে ঢোকার আগেই কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে তৃণমূলের লোকেরা। তৃণমূল কংগ্রেসের এত ভয়? আমরা তো আমাদেরই লোকের সঙ্গে কথা বলতে এসছি।”
বাম নেতার আরও সংযোজন, “খনি এলাকার মানুষ এই প্রকল্প চান না। তাঁরা আমাদের জানিয়েছেন, এই খনি হলে তাঁদেরই ক্ষতি হবে। আমরা সাধারণ মানুষের কথা শুনতেই এখানে এসেছিলাম। ”
ঠিক কী বলছেন পাচামি এলাকার মানুষ? তাঁদের স্পষ্ট দাবি, সরকারের ঘোষিত প্যাকেজ সম্পর্কে তাঁরা ওয়াকিবহাল। কিন্তু, সেই প্যাকেজ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে তাঁদের সংশয় রয়েছে। পুনর্বাসন যথাযথ হবে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন। সেদিক থেকে খনির কাজ না হলেই ভাল বলে মনে করছেন আদিবাসীদের একাংশ।
সমস্ত আশঙ্কা মেটাতে ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে পাচামি প্রকল্প সফল করতে পদক্ষেপ করছে সরকার। বীরভূম জেলাশাসক বিধান রায় স্পষ্টই জানিয়েছেন, আদিবাসীদের নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি নয়, বদলে গ্রামীণ পরিবেশেই পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
ঠিক কী বলেছেন জেলাশাসক বিধান রায়? তাঁর কথায়, “আদিবাসীদের সর্বাধিক সংশয় ছিল তাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হলে তাঁরা কোথায় যাবেন। এছাড়া তাঁদের সংস্কৃতি নষ্ট হতে পারে। সেইসব কথা চিন্তা করেই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আদিবাসীদের কোনও নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি নয়, বদলে মহম্মদবাজার ব্লকেই গ্রামীণ পরিবেশেই আদিবাসীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।”
জেলাশাসক আরও জানিয়েছেন, পাচামির কতটা এলাকা জুড়ে কয়লা রয়েছে তা জানতে দেওয়ানগঞ্জ ও হরিণশিঙায় কূপ খনন করা হবে। মাটির কতটা নীচে কয়লা রয়েছে তাও পরীক্ষা করা হবে ওই কূপ খননের মাধ্য়মেই। স্থানীয়রা যেন কোনও গুজবে কান না দেন এমনটাই দাবি করেছেন জেলাশাসক। শুধু তাই নয়, পাচামি প্রকল্প সংক্রান্ত কোনও জিজ্ঞাস্য থাকলে পঞ্চায়েত ব্লক এবং জেলার অফিসেও জিজ্ঞাসা করা যাবে। তবে লোবা নিয়ে এখনই কোনও আলোচনা হচ্ছে না বলেই জানিয়েছেন জেলাশাসক। যদিও, এই ঘোষণায় আদিবাসীদের তরফ থেকে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
দেউচা পাচামির প্রকল্পের কাজে কোমরবেঁধে লেগেছে রাজ্য সরকার। সম্প্রতি, ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের নির্দেশে দেউচা পাচামির (Deocha Pachami) একাধিক খাদান ঘুরে দেখেন রাজ্য সরকার নিয়োজিত চার সদস্যের বিশেষ প্রতিনিধি দল। এলাকায় কতটা দূষণ হচ্ছে, কয়লা খাদান হলেই বা কতটা দূষণ হতে পারে তা খতিয়ে দেখতেই মঙ্গলবার আধিকারিকরা খনি এলাকায় আসেন। যদিও তা নিয়ে প্রকাশ্যে তাঁরা বিশেষ কিছু বলতে চাননি।
দেউচা পাচামি প্রকল্প চালু হলে, মূলত খনি এলাকায় কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু হবে। এরফলে আদিবাসীদের যে জমি ও বাড়ি তা সরকারের অধীনে চলে যাবে। পরিবর্তে যে পুনর্বাসনের প্যাকেজ দেওয়া হবে, তা যথাযথ ও যথেষ্ট নয় বলেই মনে করছেন তাঁরা। পাশাপাশি, তড়িঘড়ি ওই এলাকা পরিবরর্তিত হতে পারে আসানসোল-রানিগঞ্জের মতো এক বিরাট শিল্পতালুকে। ফলে, গোটা ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশটাই বদলে যেতে পারে। সেদিক থেকে আদিবাসীরা কোথায় যাবেন এই সংশয়টাই তাঁদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা খনির সন্ধান পাওয়ার সুবাদে বীরভূমের দেউচা পাচামি কোল ব্লক এলাকার নাম এখন অনেকেরই জানা। বীরভূমের দেউচা পাচামি কয়লা খনির কাজ শুরুর বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রায় ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত দেউচা পাচামি কোল ব্লক এলাকা। প্রাথমিক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ৩০১০টি পরিবার এই খনি অঞ্চলে বসবাস করেন যার মধ্যে ১০১৩টি আদিবাসী পরিবার।
ঘোষিত সরকারি প্যাকেজে বলা হয়েছে, প্রায় ১৭ জন খাদান মালিক বাড়ির দাম ও ক্ষতিপূরণ পাবেন। ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্যাকেজের অধীনে বাড়ি দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের। ওই এলাকায় থাকা বাসিন্দা, যাঁদের বাড়ি সহ জমি রয়েছে, তাঁরা পাবেন ১০ থেকে ১৩ লক্ষ টাকা। এছাড়া অন্যান্য সুবিধা দিতে আরও পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। এছাড়া বাড়ি বা জমি হারানো অথবা বর্গদাররা পরিবার পিছু জুনিয়র পুলিশ কনস্টেবল পদমর্যাদার চাকরি পাবেন। সব মিলিয়ে এই ত্রাণ পুনর্বাসন প্যাকেজের মোট আর্থিক মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা।