কোচবিহার: শিয়রে পঞ্চায়েত নির্বাচন (Panchayet Elections 2023)। তার আগে জনসংযোগ বাড়াতে ও আমজনতার কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়াতে নয়া উদ্যোগ তৃণমূলের (Trinamool Congress)। শুরু হয়েছে ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচি। নেতৃত্বে দলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee)। দুই মাস ধরে জেলায় জেলায় ঘুরে আমজনতার কথা শুনবেন তিনি। আর এই কর্মসূচি থেকেই তৈরি হবে পঞ্চায়েতের প্রার্থী বাছাইয়ের ব্লু-প্রিন্ট। মঙ্গলবার অভিষেকের সেই জনসংযোগ যাত্রার প্রথম দিন। কোচবিহার থেকে শুরু হচ্ছে অভিষেকের এই জনসংযোগ কর্মসূচি।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বললেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আপনাদের মাঝে যাঁরা দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়েছিল, সেই দেওয়াল ভাঙতে আমি এসেছি। আজ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আপনাদের মাঝে আর কেউ নেই।’
অভিষেক বললেন, ‘এমন পঞ্চায়েত গড়তে হবে, যাতে উন্নয়ন আগামী দিনে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। যে লোক থাকবে, তিনি যেন মানুষের জন্য ১০ দিনের কাজ দুই দিনে করতে পারেন, এমন মানুষকে বেছে নেবেন। তাই আজ আপনাদের কাছে ব্যালট বাক্স নিয়ে এসেছি।’
অভিষেক বললেন, ‘আগামী দিনে দুয়ারে রেশন চালু হবে। সুপ্রিম কোর্টের বাধ্যবাধকতার কারণের দুই বছর এটি আটকে ছিল। এখন আর কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।’
নাম না করে এলাকার সাংসদ নিশীথ প্রামাণিককে নিশানা করলেন অভিষেক। বললেন, ‘এখানকার সাংসদ একজন প্রতিমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় যুব কল্যাণ মন্ত্রক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্বে রয়েছেন। কোচবিহারে একটিও স্পোর্টস কমপ্লেক্স কেন্দ্রীয় সরকার গত নয় বছরে করেছে?’
সিতাইয়ের সভা থেকেও প্রার্থী বাছাইয়ের ব্যালট বাক্স দেখালেন অভিষেক। বললেন, ‘এই ব্যালট বাক্স কেউ সরাসরি খুলবে না। আমি খুলব। আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের পরিচয় গোপন থাকবে।’
কেন কোচবিহার থেকেই শুরু করা হল এই কর্মসূচি, সেই কথা সিতাইয়ের সভা থেকে জানালেন অভিষেক। বললেন, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি – এই তথাকথিত উত্তরবঙ্গ কথার আমি ঘোর বিরোধী। আমি মনে করি পশ্চিমবঙ্গ যদি একটি মানবিক শরীর হয়, তাহলে কোচবিহার হল তার মাথা। মাথা না থাকলে শরীরের কোনও দাম নেই।’
সাহেবগঞ্জের সভার পর এবার কোচবিহারের সিতাইয়ে অভিষেকের সভা। সিতাইয়ের ভিড় দেখে আপ্লুত অভিষেক। বললেন, ‘১০-১২টি পঞ্চায়েত নিয়ে এই সমাবেশ ছিল। কিন্তু যেভাবে মানুষ কাঠফাটা রোদ্দুর উপেক্ষা করে এখানে এসেছেন, দেখে মনে হচ্ছে রাজ্যস্তরের সমাবেশ হচ্ছে।’
সভামঞ্চ থেকে একটি বিশেষ ধরনের ব্যালট পেপার দেখালেন অভিষেক। বললেন, ‘এই ব্যালট পেপার সকলকে দেওয়া হবে। সেখানে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রার্থীর নাম জানানো যাবে। এটি গোপান ব্যালট। আপনার নাম বা কিছু থাকবে না। এটি পূরণ করে ব্যালট বক্সে ফেলে দিন। তারপর মানুষ যাঁকে মান্যতা দেবে, তৃণমূল তাঁকেই প্রার্থী করে জেতাবে। বাংলায় ৩৩৪৩টি পঞ্চায়েত রয়েছে। সব জায়গায় আমি যাব। মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে ছাড়ব।’ অভিষেকের দাবি, এমন উদ্যোগ ভারতে কোনওদিন হয়নি। বললেন, ‘একশো টি ভোটের মধ্যে যদি ৫১ জন মানুষর বলে আমার অমুক প্রার্থীকে চাই, তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস তাঁকেই প্রার্থী করবে। যাঁরা ব্যালট বক্সে ভোট দিতে পারবেন না, তাঁদের জন্য ৭৮৮৭৭৭৮৮৭৭ নম্বরও দিয়ে দিলেন। বাড়ি থেকে গ্রাম পঞ্চায়েতের নাম, বুথের নাম ও আসন নম্বর উল্লেখ করে পছন্দের প্রার্থীর নাম জানানো যাবে বলে জানালেন অভিষেক।
অভিষেক বললেন, ‘আপনার বুথে কে প্রার্থী হবে, তা তৃণমূল কংগ্রেস ঠিক করবে না। আপনি যাঁকে প্রার্থী হিসেবে মান্যতা দেবেন, দলের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আমরা তাঁকে জিতিয়ে আনব। মানুষ ঠিক করবে মানুষের প্রার্থী কে।’
অভিষেক বললেন, ‘শুধু নিজের ভোট নিজে দিন, এই কথা নয়। নিজের ভোট তো নিজে দেবেনই। সেই সঙ্গে নিজের প্রার্থী বেছে নিন। এটা কেউ করবে না। আমাদের দরকার ছিল না রাস্তায় নেমে মানুষের পাশে থাকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ২০২৬ সালের মে মাস পর্যন্ত ক্ষমতায় রয়েছে। তার আগেই আমরা রাস্তায় নেমে আপনাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কারণ একজন বিধায়ক বা সাংসদ উন্নয়ন করতে চাইলেও পঞ্চায়েতে সঠিক প্রতিনিধি না থাকলে উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হয়।
অভিষেক বললেন, ‘আগামী পঞ্চায়েতে কোনও ধর্মীয় ভাবাবেগ নয়, মোদীজির ৫৬ ইঞ্চির ছাতি নয়, বালাকোটের নামে নয়, আপনার বাড়ির শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আপনাকে ভোট দিতে হবে। গ্রামে যাতে রাস্তা হয় এবং একশো দিনের কাজের টাকার দাবি যাতে দিল্লির বুক থেকে আপনি ছিনিয়ে আনতে পারেন, সেই জন্য ভোট দিতে হবে। নিজের অধিকার বুঝে নিতে, নিজের প্রার্থীকে বেছে নিতে ভোট দিতে হবে।’
উত্তরবঙ্গের ইস্যুতে আবার সরব অভিষেক। বললেন, ‘তথাকথিত উত্তরবঙ্গ বলে একটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করে কেউ কেউ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তাঁদের ভোট নিয়ে পৃথক রাজ্য করার দাবি তুলেছে। তারা আপনাদের পাশে কখনও দাঁড়ায়নি। আগামী দিনে যখন ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, নিজের পঞ্চায়েতের কথা ভেবে করবেন। ২০১৯ সালে যখন আপনারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন, তখন একশো দিনের কাজ, আবাস, গ্রামের রাস্তার কথা ভেবে করেননি। কেউ বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন ২০১৯ সালে গ্রামের রাস্তা, পানীয় জল, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা সামনে রেখে ভোট দিয়েছিলেন?’
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বললেন, ‘আমাদের একটাই অহঙ্কার। তা হল মানুষের সমর্থন এবং আগামী দিনে মানুষের পঞ্চায়েত গঠন করা। আপনারা পঞ্চায়েতে কাকে প্রার্থী চান, তা জানতে এসেছি। আমি এখানে রাজনৈতিক কথা বলতে আসিনি। রাজনৈতিক কথা হয়ত সারাবছর আপনারা শোনেন আমার মুখ থেকে।’
অভিষেক বললেন, ‘একটু অসুবিধা, কষ্ট হলেও, আগামী দিনে মানুষের পঞ্চায়েতের কথা ভেবে আমার কথা আপনাদের শুনতে হবে। দুই মাসের জন্য ঘর-বাড়ি-পরিবার-বন্ধু-বান্ধব সব ছেড়ে এসেছি আপনাদের সঙ্গে থাকব বলে। কোনও শাসক দল এভাবে রাস্তায় নামে না, বিরোধী দল নামে। আমরা ক্ষমতা থেকেও রাস্তায় নামছি, মানুষের পাশে যাচ্ছি। কারণ আমাদের কোনও অহঙ্কার নেই।’
অভিষেক বললেন, ‘কোচবিহারে আসার সময় যে উচ্ছ্বাস কোচবিহারবাসীর দেখেছি, তার জন্য আমি চিরজীবন আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আজ প্রথম মিটিং আমরা সাহেবগঞ্জ থেকে শুরু করছি। গরমে আপনাদের খুব কষ্ট হচ্ছে আমি জানি। আমি তিনটি কর্মসূচি করে এসেছি। আমি তিনটি কর্মসূচি করে এসেছি। আরও তিনটি কর্মসূচি রয়েছে। গরমে সবার একটু কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আগামী দিনে যদি এই প্রয়াসকে সফল ও স্বার্থক করতে হয়, তাহলে এই কষ্ট আমাদের সহ্য করতে হবে।’
কোচবিহার থেকে মঙ্গলবার শুরু হল অভিষেকের দুই মাসের জনসংযোগ কর্মসূচি। বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত দুই যুবকের পরিবারের সঙ্গে এদিন বামনহাটের ক্যাম্পে দেখা করলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্য়ায়। মাথাভাঙা, দিনহাটায় একাধিক কর্মসূচি করার কথা রয়েছে তাঁর।
এদিন সকালে দিনহাটার বামনহাটে তাঁর ক্যাম্পের অদূরেই একটি মন্দিরে পৌঁছে যান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্দিরে যাওয়ার সময় পথের দু’পাশে থাকা মানুষজনের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। বামনহাটের এই মন্দিরে পুজো দিয়ে তারপর দিনভর জনসংযোগে ঠাসা কর্মসূচি রয়েছে অভিষেকের।