গুড়াপ: মাত্র দেড় বছর বয়স তখন। আদো আদো কথা বলতে শিখেছিল। তখন তাঁর জীবনে ঘটেছিল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ উঁচু থেকে নিচে পড়ে যান। মাথায় প্রচণ্ড চোট পেয়েছিলেন। শরীরের নাক, মুখ ,কান দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। পরিবার তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে গেলেও, শেষ পর্যন্ত ছেলের আর মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরয়নি। তখন থেকেই সারা জীবনের মতো হারিয়ে ফেলেছিলেন কথা বলার ক্ষমতা। ইচ্ছা ছিল জীবনে পুলিশে চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছে। কিন্তু মনের সেই অদম্য জেদ আর কাজের প্রতি ভালবাসা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের দায়িত্বে ট্রাফিক সামলাচ্ছেন চন্দ্রনাথ। গুড়াপের ব্যস্ততম জায়গা বেলতলা মোড়। একাধিক দূরপাল্লার বাস ছাড়াও ট্রেকার অটো টোটো যাতায়াত করে এই মোড় দিয়ে। সেই ব্যস্ততম মোড়ে নিয়ম করে সকাল বিকেল দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজিয়ে ট্রাফিক সামলে যাচ্ছেন চন্দ্রনাথ।
হুগলির গুড়বাড়ি দুই নং পঞ্চায়েতের রোহিয়া গ্রামের বাসিন্দা চন্দ্রনাথ ঘোষ। প্রতিবন্ধী স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ইতি টানতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর বাবা বিশ্বনাথ ঘোষ যাত্রাদলে অভিনয় করে যা উপার্জন করতেন তা দিয়েই কোনও ক্রমে সংসার চলত তাঁদের। আর সম্বল বলতে তাঁদের দুই বিঘা জমি। কিন্তু ছেলের চিকিৎসার জন্য কখনও পিছু পা হয়নি তাঁরা। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু নিয়ে গিয়েও ছেলের মুখ দিয়ে আর কথা বলাতে পারেননি চন্দ্রনাথের বাবা মা। সময়ের কালে বিবাহের পর বর্তমানে দুই সন্তান, স্ত্রী ও বাবা মাকে দেখাশোনার দায়িত্ব তারই কাঁধে। তাঁর এক ছেলে। সেও শারীরিকভাবে বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন।
চন্দ্রনাথের বাবা হার্ট ও লিভারের সমস্যায় ভুগছেন। শত প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে গত দু’বছর ধরে গুড়াপ থানার অনুমতি সাপেক্ষে বেলতলা মোড় এলাকায় ট্রাফিক সামলে যাচ্ছেন চন্দ্রনাথ। রোদ, জল, ঝড়, বৃষ্টি যাই আসুক না কেন, তাঁকে কোনও দিন ও কর্তব্যে পিছু পা হতে দেখেননি স্থানীয়রা। বাড়ি থেকে প্রতিদিন প্রায় দু কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে হাজির হন গুড়াপ থানার বেলতলা এলাকায়। সেখানেই সকাল সন্ধ্যা ট্রাফিক সামলান চন্দ্রনাথ। চোখে কালো চশমা, গায়ে ট্রাফিক পুলিশ লেখা পোশাক, মুখে বাঁশি নিয়ে ট্রাফিক সামলে চলেছেন তিনি। আর তাঁর এই কাজে খুশি স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ। এলাকার সকলের কাছে খুব প্রিয় চন্দ্রনাথ। পুলিশ প্রশাসনও তাঁকে বিভিন্ন রকম ভাবে যথাসাধ্য সাহায্যের চেষ্টা করে থাকে।
চন্দ্রনাথের বাবা-মা জানান, “ছেলের ছোটবেলায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তারা জানিয়ে দেয় ভোকাল কড ও কানে পর্দা ফেটে যায়। সে আর কথা বলতে পারবে না। তখন থেকে আজও ছেলের মুখে কথা বের হয়নি। তবে ছেলের এই কাজে হুগলি গ্রামীণ পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন সাহায্য করেছে। পুলিশ সুপারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তবে আমরা চাই ছেলের একটা স্থায়ী কিছু হোক। তার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে আমার করজোরে নিবেদন তারা যেন ছেলের জন্য কিছু করেন।”
বেলতলা এলাকার ব্যবসায়ীরা বলেন, “চন্দ্রনাথ কথা বলতে পারে না। বাঁশি বাজিয়ে ট্রাফিকের সমস্ত দায়িত্ব সামলান। চন্দ্রনাথ যতদিন আছে ততদিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। সকলের সাথেই ভাল ব্যবহার করে এবং প্রতিদিন সময় মতো ট্রাফিক সামলাতেও চলে আসে।” হুগলি গ্রামীণ পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন বলেন, “চন্দ্রনাথ খুব ভাল কাজ করে, আমার কাছে এসেছিল। অনেকদিন ধরেই ওখানে ট্রাফিক সামলায়। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। আমাদের থেকে যতটা সাহায্য পাওয়ার আমরা তাঁকে করব। তবে আমরা যতটা পারবো চেষ্টা করব তার জন্য কিছু করার।”