কলকাতা: ফাল্গুনের শেষের দিক। শীতের বিদায়ে তপ্ত রোদের ভ্রুকূটি। এই সময় দিল্লি রোডের ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা যাবে, একের পর এক ৪০৭ ম্যাটাডোর ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে। সওয়ারীরা নানা বয়সের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। সবার গন্তব্য একটাই। ফুরফুরা শরিফ (Furfura Sharif)। বাঙালি মুসলিমদের ‘মক্কা’ বললেও ভুল হবে না। এই সময় ফুরফুরা শরিফকে কেন্দ্র করে কয়েক লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, বাংলাদেশের বহু মানুষও আসেন এই পবিত্র স্থানে। এঁদের অধিকাংশই বাঙালি। ধর্মের বেড়াজাল পেরিয়ে বাংলা ভাষা আজ যে বিশ্বমাত্রিক পরিচয়ে দিনযাপন করছে, তার মজ্জাতেও প্রবাহমান ফুরফরা শরিফের ইতিহাস। আর এই ফুরফুরা শরিফ যাঁর হাত ধরে লাখো ভক্তের আবেগ ও বিশ্বাসের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে, তিনি সমাজ সংস্কারক পীর আবু বকর সিদ্দিকি (Pir Abu Bakr Siddique)। তাঁরই উত্তরসূরি আব্বাস সিদ্দিকিকে নিয়ে আজ মশগুল বাংলার রাজনৈতিক মহল। কে তিনি, কী তাঁর পরিচয়, কেনই বা তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতি বা তিনি মৌলবাদী না ধর্মনিরপেক্ষ? ভোটের বাজারে এ সব প্রশ্ন যখন সবার মুখে মুখে, তখন হাওয়ায় কান না দিয়ে আব্বাস সিদ্দিকির শিকড় খোঁজার চেষ্টা করল TV9 বাংলা ডিজিটাল।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক মহম্মদ মজলুম খান বলছেন, ফুরফুরার পীর আবু বকর সিদ্দিকি (১৮৪৬-১৯৩৯) হলেন উনবিংশ শতাব্দীর অবিভক্ত ভারতের একজন শিক্ষিত, অত্যন্ত সম্মানিত ও প্রভাবশালী সুফি। এই বৃত্তের বাইরেও আবু বকরকে জানা যায় একজন সমাজ সংস্কারক (মুজাদিদ-ই-জ়ামন) হিসাবে। শিক্ষা, ধর্ম এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁর অবদান থাকায়, তাঁকে ‘দাদা হুজুর পীর কুবলা’ (Dada Huzur Pir Qebla) বলেন ভক্তরা। হুগলির জাঙ্গিপাড়া ব্লকের ফুরফুরা শরিফ গ্রামে ১৮৪৬ সালে ১৮ মার্চ জন্ম তাঁর। ‘শজরনামা’ মতে, প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিকির বংশধর হলেন ফুরফুরার এই পীর। খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছেন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের স্কুলেই, এরপর উচ্চশিক্ষা লাভ করেন সীতাপুর এন্ডোমেন্ট মাদ্রাসা এবং বাংলার অন্যতম পুরনো মাদ্রাসা হুগলির মহসীন থেকে। এখান থেকেই তিনি লাভ করেন জামিয়েত-উল-উলা ডিগ্রি।
এরপর কলকাতা চলে আসেন আবু বকর। বিখ্যাত ইসলামিক পণ্ডিত মৌলানা সৈয়দ আহমেদ শাহিদ এবং হাফিজ় মৌলানা জামালউদ্দিনের থেকে কোরান, হাদিস, তফসির, ফিখ, ফারেইজ শেখেন। মদিনাতেও যান আবু বকর। মৌলানা সৈয়দ আমির রেজ়ওয়ানের থেকে হাদিসের পাঠ নেন। কলকাতার মানিকতলায় পীর-ও-মুরশিদ শাহ সুফি সৈয়দ ফতে আলি ওয়েইসির থেকে বাতিন (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) লাভ করেন আবু বকর। হানাফি স্কুলের অন্যতম অনুগামী ছিলেন তিনি।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মে তখন এক বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে বাংলায়। বলা ভাল, নবজাগরণের কর্মযজ্ঞ। এক দিকে কেশব চন্দ্রের হাত ধরে ব্রাহ্মধর্ম ত্বরাণ্বিত হচ্ছে। অন্যদিকে, ভাববাদী ধর্মের প্রবেশ ঘটাচ্ছেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। বাংলায় একাধিক মনীষীর পৌরহিত্যে আমুল সংস্কার ঘটছে জীর্ণ হিন্দু ধর্মে। পিছিয়ে ছিল না ইসলামও। ভৌগলিক কারণে সাধারণত বাঙালি মুসলিমরা ছিলেন কৃষি নির্ভরশীল। অধিকাংশই দারিদ্র সীমার নীচে। এই সব মানুষ সহজেই সুফি ভাবধারায় প্রভাবিত হন। বাংলায় প্রায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সুফিবাদের প্রবেশ ঘটে। কিন্তু মুঘল জমানায় এই ভাবধারা যতটা না বিস্তার করে, ব্রিটিশ আধিপত্যের জেরে সুফিবাদ গভীর প্রভাব ফেলে গরিব, সাধারণ মুসলিম সমাজে। প্রত্যন্ত গ্রামে শুধুই বাঙালি মুসলিম নয়, হিন্দুরাও সুফি ভাবধারায় প্রভাবিত হন। এই সময় উলেমা (আধ্যাত্মিক পণ্ডিত), সুফিরা শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রে নয়, সমাজের নীতি নির্ধারক হয়ে ওঠেন। তবে, আবু বকর সিদ্দিকি আরও এক কদম এগিয়ে নিজেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যান।
আধ্যাত্মিক গুরু থেকে আবু বকর সমাজ সংস্কারক হয়ে ওঠেন বিংশ শতাব্দীতে। আর পাঁচটা পীরের মতো পীরের পুজো, সমাধিতে চাদর চড়ানো, পীরের পা ছুঁয়ে সম্মান প্রদর্শন কিংবা পীরের জন্ম বা মৃত্যু বার্ষিকী অনুষ্ঠান–এ সব পছন্দ করতেন না আবু বকর। বরং তিনি মনে করতেন, সুফিবাদের একমাত্র কাজ মানুষের সেবা (খিদমত-ই-খালক) করা এবং ধর্মকে রক্ষা করা (তাহফুজ়-ই-দিন)। এই ভাবধারার উপর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে গড়ে ওঠে তাঁর ‘অনজুমান-ইওয়াজ়িন-ই-বাংলা’ ও জামিয়েত-ই-উলেমা-ই-বাংলা-অসম। প্রথাগত সুফিবাদ এবং পীরবাদকে উপেক্ষা গ্রাম-বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন আবু বকর। এর জন্য সারা বাংলায় একাধিক ‘ওয়াজ়-ই-মেহফিল’ (ইসলামিক বিতর্ক) ও বাহাস (মৌলানা এবং মৌলবীদের যুক্তি-তর্ক) আয়োজন করেন তিনি।
ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছে আবু বকর সিদ্দিকিকে। প্রত্যক্ষভাবে খিলাফৎ আন্দোলন (১৯১৯-২৪), মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। আবু বকর বলতেন, শত্রু (দারুল-হার্ব) (ব্রিটিশ শক্তিকে উদ্দেশ্য করে) বা ইসলামের জায়গার (দারুল-ইসলাম) থেকে এই দেশ অনেক বেশি শান্তির জায়গা (দারুল-আমন)। তিনি চেয়েছিলেন যাতে সব জাতি, সম্প্রদায়, ধর্মের মানুষ পরস্পরের স্বাতন্ত্র বজায় রেখে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেন এখানে। ধর্ম নিরপেক্ষ দেশের স্বপ্ন দেখতেন আবু বকর। আর সেই ভাবনা থেকেই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ত্রাণ শিবির সংগঠন (জামিত-ই-উলেমা-বাংলা) গড়ে তুলেছিলেন বকর। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সেবা করত তাঁর সংগঠন।
উনবিংশ শতাব্দীতে নারী শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন আবু বকর। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে নারীদের অধিকার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার নিয়ে সচেষ্ট হন তিনি। অধুনা বাংলাদেশে বাগুরা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, পাবনা, বরিশাল-সহ উত্তর ২৪ পরগনা, হুগলির বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করেছেন মাদ্রাসা স্কুল। এই সব স্কুলে প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াও বিজ্ঞান, প্রযুক্তির মতো বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত। একাধিক সংবাদপত্র ও প্রকাশনা করেছেন তিনি। ইসলাম দর্পন, শরিয়ত-ই-ইসলাম, মিহির-ও-সুধাকর, দ্য মুসলমান, ইসলাম হৈতষী, বঙ্গনুর-সহ এক ডজন সংবাদপত্র প্রকাশনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল তাঁর।
বাঙালি মুসলিমদের উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন আবু বকর সিদ্দিকি। তাই নিজের উদ্যোগে বাংলায় সংবাদপত্র, সাহিত্য প্রকাশনা করে বাংলা-প্রীতি তৈরিতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। তাঁর পত্রিকা ‘নবনুর’-এ তিনি বলছেন, বাংলা ছাড়া বাঙালি মুসলিমদের আর কি মাতৃভাষা হতে পারে? মাতৃভাষার জায়গায় কেউ যদি উর্দু গ্রহণ করেন, তা দুর্ভাগ্যজনক। ধর্মীয় প্রচারে নিজেই বাংলা ভাষাকে হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন আবু বকর। মনে করা হয়, আবু বকর সিদ্দিকির সৌজন্যে ভারতে উর্দু-ইসলামের পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে জায়গা করে নিয়েছে বাংলার ইসলাম। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে আসাদউদ্দিন ওয়েইসির মিমের লড়ার পিছনে যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা হল বাঙালি মুসলিম। ওয়াকিবহালের মতে, উর্দুভাষী মুসলিমের সংখ্যা বেশি না থাকায় বাধ্য হয়েই, আব্বাস সিদ্দিকির হাত ধরার পথে ওয়েসিকে হাঁটতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পীর আবু বকর সিদ্দিকির ভূমিকা অনস্বীকার্য তা বলাবাহুল্যই।
তথ্য সৌজন্যে: অধ্যাপক আবদুল মতিন, অধ্যাপক জ়াদ মামুদ
আরও পড়ুন- একুশে ফের ব্রিগেড সমাবেশ হবে, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন সংযুক্ত মোর্চার নেতা: সিদ্দিকি