তারকেশ্বর : বাড়িতে দুই সন্তান। স্বামী ট্রেনে হকারি করেন। পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে চোখ ভরে উঠল জলে। তবে তারকেশ্বরের অ্যাথলিট (Athlete) বুল্টি রায়ের স্বপ্নকে টলাতে পারেনি আর্থিক প্রতিবন্ধকতা। সম্প্রতি তামিলনাড়ুতে জাতীয় স্তরের বয়সভিত্তিক দৌড় প্রতিযোগিতায় একাধিক মেডেল পেয়েছেন। এখন মালয়েশিয়ায় রয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতা। ওই প্রতিযোগিতায় যোগদানের স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু, তার জন্য যে খরচ পড়বে, তা জোগানোর সামর্থ্য নেই তাঁর পরিবারের। এখন কী করবেন বুঝতে পারছেন না তারকেশ্বরের এই অ্যাথলিট। চাইছেন, তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসুন কেউ। সংসারের অনটন মেটাতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চাকরিরও আবেদন জানালেন তিনি।
তারকেশ্বর পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের জয়কৃষ্ণ বাজার এলাকায় একটি ছোট্ট টালির চালের ঘর। স্বামী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে সেখানেই বাস করেন বছর তিরিশের বুল্টি। বাড়িটি নিজেদের নয়। ভাড়াবাড়ি। স্বামী সন্তোষ দাস ট্রেনে হকারি করেন। ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ে। স্বামী যা আয় করেন, তাতে ঠিকমতো সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
ছোট থেকেই অভাব-অনটনের সঙ্গেই বড় হয়েছেন বুল্টি। তাঁর বাপেরবাড়ি জাঙ্গিপাড়ায়। ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়। কিন্তু, দৌড়নোর স্বপ্ন কখনও ত্যাগ করেননি। ছোটবেলায় শিবপ্রসাদ ধাড়ার কাছে কোচিং নিতেন। কয়েক বছর ট্রেনিং নেওয়ার পর আর তা সম্ভব হয়নি। তারপর থেকে তিনি নিজেই নিজের কোচ।
অনুশীলনের জন্য ভাল ট্র্যাক প্যান্ট বা গেঞ্জি নেই। নেই ভাল জুতো। এমনকি একজন অ্যাথলিটের যে ধরনের খাবার প্রয়োজন, তা কোনওদিন পাননি। কোনও দিন আলু ভাতে দিয়ে পান্তা ভাত। কোনও দিন শাক ভাত। জোটেনি একটা গোটা ডিম। তবে তাঁর ইচ্ছাশক্তিকে দমানো যায়নি। দুই সন্তানকে মাঠে বসিয়ে রেখে কঠোর অনুশীলন করে যান। তাই তো বাড়িতে খাবার না জুটলেও টিনের ট্যাঙ্কে ভর্তি হয়ে আছে রাজ্য ও জাতীয় স্তরের বহু শংসাপত্র এবং সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জের মেডেল।
গত ২৭ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত তামিলনাড়ুর জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ৪২ তম জাতীয় মাস্টার্স অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বয়স ভিত্তিক দৌড় প্রতিযোগিতায় বাংলার হয়ে পাঁচটি মিটে অংশগ্রহণ করেন বুল্টি। তিনি অংশ নিয়েছিলেন ৩০ থেকে ৩৫ বছরের দৌড় প্রতিযোগিতায়। সেখানে ২০০ মিটার দৌড়, ৪০০ মিটার দৌড় এবং ৪০০ মিটার হার্ডলসের স্বর্ণ পদক লাভ করেন তিনি। আর ১০০ ও ৪০০ মিটার রিলেতে রুপো পান।
টিভি নাইন বাংলাকে নিজের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে চোখ জলে ভরে উঠল বুল্টির। বললেন, “ভাল জুতোর দাম ১০-১৫ হাজার টাকা। দুটো ভাল জুতো লাগে। কিন্তু, ওই জুতো কেনার সামর্থ্য নেই। কোনওরকমে সংসার চলে। কিন্তু, স্বামীকে বলে দিয়েছি, দৌড়নো ছাড়তে পারব না।” তাঁর আক্ষেপ, অন্য জায়গায় জাতীয় স্তরের খেলোয়াড়দের সবাই চেনে, সাহায্যও পান তাঁরা। কিন্তু, তারকেশ্বরেই কেউ চেনে না তাঁকে।
চেন্নাইয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছিলেন তিনি। এখন আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার জন্য মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু, তার জন্য খরচ পড়বে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার মতো। বুল্টি বলেন, “অত টাকা স্বপ্নেও দেখিনি। তাহলে পাব কোথায়?” অলিম্পিকসে খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়নি তাঁর। তাই, আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার জন্য মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। বুল্টির অনুরোধ, “কেউ এগিয়ে এলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।”
নিজের খাবার নিয়ে অত ভাবেন না বুল্টি। কিন্তু, ছেলেমেয়ের মুখে দুটো ভাল খাবার তুলে দিতে না পারার যন্ত্রণা কুরে কুরে খায়। সেকথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। কান্না ভেজা গলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আর্জি জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী যদি একটা চাকরি দেন, তাহলে তাঁর পরিবার খেয়ে পরে থাকতে পারবে। এর সঙ্গে নিজের স্বপ্নের পিছনে আরও দৌড়তে পারবেন বছর তিরিশের বুল্টি।