West Bengal Panchayat Elections 2023: ‘আমার মতো কোনও বাচ্চার যেন না হয়’, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রার্থনা ১৮-তে বোমায় হাত খোওয়ানো পৌলমীর

Saumav Mondal | Edited By: শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী

Jun 23, 2023 | 6:39 PM

West Bengal Panchayat Elections 2023: পৌলমীর চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠল। তখনই পৌলমীর বাবার ফোনটা বেজে উঠল। পৌলমী বলল, 'দেখো বাবা আবারও কেউ আশ্বাস দেবেন হয়তো?' মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বললেন, 'যেন তাই হয়...'

West Bengal Panchayat Elections 2023: ‘আমার মতো কোনও বাচ্চার যেন না হয়’, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রার্থনা ১৮-তে বোমায় হাত খোওয়ানো পৌলমীর
পৌলমী
Image Credit source: TV9 Bangla

Follow Us

বসিরহাট: বাড়িতে অনেক মুরগি, মুরগির ছানা। পৌলমীও তাদের সঙ্গেই বেড়ে উঠছিল। বাড়ির সামনে উঠোনে খেলে বেড়াত, ছুটে বেড়াত, দু’হাতে কোলে তুলে নিত তাদের। বাড়িতে ডাকতে আসত পাড়ার বন্ধুরা। ব্যাডমিন্টন, কিত কিত কতই না খেলা! কিন্তু পৌলমী তার এ জীবন শেষ করেছে মাত্র সাত বছর বয়সেই। এখন সে বারো। পৌলমী এখন স্কুল যায় আর বাড়ি ফেরে, ঘরেই বন্দি। বন্ধুরা আর তাকে ডাকতে আসে না খেলার জন্য। মুরগির ছানাগুলোকে আর কোলে তুলে নিতে পারে না সে। বাঁ হাতটা যে তার কবজির নীচ থেকে নেই। এক হাতে তার প্রয়োজনীয় কাজ করতেই সময় পেরিয়ে যায় অনেকটা। চুল বাঁধা হোক কিংবা জামা পরা। কিংবা উঁচু তাক থেকে বইয়ের ব্যাগটা নামানো-সবটা করতেই বেশ কিছুটা ভারসাম্যের অভাব হয় পৌলমীর। তাই আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে আলাদা রাখে নিজেকে। কিন্তু ঠিক পাঁচ বছর আগে আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে পৌলমীর জীবনটা ছিল শীতের রোদের মতোই ঝিলমিল। একটা বোমা তার জীবনটা বদলে দিয়েছে। মসৃণ পথটাই অনেকটা চড়াই উতরাই করে তুলেছে।

স্কুলে পৌলমী

দিনটা ছিল ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল। বসিরহাটের হাড়োয়ার গোপালপুর ১নং গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা শম্ভু হালদার ও দিপালী হালদারের ছোট মেয়ে পৌলমী প্রতিদিনের মতো সেদিন সকালেও বাড়ির সামনের ফুল গাছ থেকে ফুল তুলতে গিয়েছিল। গাছের নীচেই পড়েছিল একটি বোমা। বল ভেবে সেই বোমাকেই হাতে তুলে নেয় সে। নতুন ‘বল’ পেয়েছে, মন তখন ফুরফুরে। ছুটে এসেছিল দাদুকে বলটা দেখানোর জন্য। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল দাদুর। বুঝতে পেরেছিলেন বোমা। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হিসাবে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ছুড়ে ফেলে দিতে বলেছিলেন বোমাটিকে। ছোট্ট পৌলমী কিছু বুঝে ওঠার আগেই বোমাটিকে ছুড়ে দেয়। আর সব শেষ… যখন পৌলমীর জ্ঞান ফিরল, তখন সে হাসপাতালের বেডে। চোখ খুলে দেখেছিল সামনে দাঁড়িয়ে তার মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমা। মুখে অম্লান হাসি। কিন্তু হাতের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল পৌলমী। সেদিনের পর থেকে বাঁ হাত হারানোর যন্ত্রণা বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে পৌলমী।

সেদিনের সেই ঘটনা গোটা রাজ্যকে তোলপাড় করেছিল। সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। শাসক-বিরোধী নেতৃত্বের মুহুর্মুহু ফোন, প্রতিশ্রুতি। ঘটনার পর স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সহযোগিতায় ও ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাসের উদ্যোগে প্রায় ৮ লক্ষ টাকা ব‍্যয়ে একটি কৃত্রিম হাতের ব্যবস্থা করা হয় পৌলমীর জন্য।

কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পাওয়া সেই কৃত্রিম হাত পরেই পৌলমী কাটিয়েছে কয়েকটা বছর। কিন্তু এখন সেই হাত প্লাস্টিকে পুরে আলমারিতে সযত্নে তোলা। পৌলমী এখন বড় হয়েছে, লম্বা হয়েছে, শারীরিক নানা পরিবর্তনও হয়েছে। তাই ছোট্ট বয়সের সেই কৃত্রিম হাত যে আর বাড়েনি। তাই তা আর শরীরেও ঢোকে না।

প্লাস্টিকের সেই হাত

টিনের চালের এক চিলতে বাড়ি পৌলমীর। সেই চালে ফুটো। ঘরে চৌকিতে বসেই সেই ফুটো দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখে পৌলমী। স্বপ্ন দেখে আকাশছোঁয়ার। স্বপ্ন দেখে যদি তারও দুটো হাত থাকত। যদি কোনও অলৌকিক ক্ষমতা, যদি ঠাকুর তাকে তার হাত ফিরিয়ে দিত! কিন্তু যখন খাটে শোয়া তার অসুস্থ বাবার দিকে চোখ পড়ে, স্বপ্ন মনেই পুষে রাখে সে।

বাড়ির উঠোনে পৌলমী

কয়েক বছর ধরে বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শোওয়া। মুরগি পালন করেই চলে সংসার। যা আয় হয়, তা ফুরিয়ে যায় চাল-নুন কেনার গার্হস্থ্য অনুশাসনেই। তারপর পৌলমীর পড়াশোনা রয়েছে। ফলে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে হাত বানানো তো পৌলমীর কাছে বিলাসিতারও উর্ধ্বে।

পৌলমীর মা দিপালী হালদার বলেন, “যদিও দুর্ঘটনার দিনগুলিতে তৃণমূলের নেতারা যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। এমনকি পৌলমীর জন্য কৃত্রিম হাতেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি আশ্বাসও দিয়েছিলেন যে আগামী দিনে পরিবারের পাশে থাকবে।” কিন্তু এখন পৌলমীর মায়ের গলায় কিছুটা আফসোসও শোনা গেল। চাকরির প্রতিশ্রুতি মিলেছিল, বাস্তবে তা আর রূপায়িত হয়নি।

তৃণমূলের বসিরহাট সাংগঠনিক জেলার আইএনটিটিউসির সভাপতি কৌশিক দত্ত বলেন, “মাঝখানে বেশ কয়েক বছর কোভিডের জন্য একটু সমস্যার জেরে আমরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা আমরা রাখতে পারিনি। পঞ্চায়েত ভোট মিটে গেলে আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। এবং পৌলমীর পরিবারের পাশে থাকার সমস্ত রকম চেষ্টা করব।”

বিজেপির বসিরহাট সাংগঠনিক জেলা যুব মোর্চার সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুন্ডু অবশ্য এই নিয়েছে শাসককে বিঁধেছেন। তাঁর বক্তব্য, “তৃণমূল শুধু প্রতিশ্রুতিই দিতে পারে। কারণ প্রতিশ্রুতি দিতে কোনও ট্যাক্স লাগে না। তারা প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান কিন্তু বাস্তবে তা আর রূপায়িত হয় না।”

পাঁচ বছর পেরিয়ে আবারও বাংলায় নির্বাচন। লোকমুখে, সংবাদ শিরোনামে, টিভিতে সবেতেই দেখছে পৌলমী। বোমাবাজির খবর দেখলে কিংবা শুনলেই নিজেকে এড়িয়ে নিচ্ছে পৌলমী। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমাতেই। পৌলমী আর এই শব্দটাই শুনতে চায় না। চায় না, তার মতো আরও কোনও শৈশবের জীবন নষ্ট হোক। আর কোনও বাচ্চাকে এইভাবে এক হাত, কিংবা এক পা বা দৃষ্টি হারিয়ে বাঁচার লড়াই চালাতে হোক! ‘পঞ্চায়েত সমিতি’, ‘গ্রাম পঞ্চায়েত’, ‘জেলা পরিষদ’, ‘শাসক’ কিংবা ‘বিরোধী’, ‘জয়’ কিংবা ‘পরাজয়’ এই শব্দবন্ধগুলোর সঙ্গে এতটুকুও ওয়াকিবহাল নয় পৌলমী। এত্ত টুকু বয়সে পৌলমী শুধু চিন্তিত, বোমাবাজি, গুলির লড়াই, হিংসা নিয়েই।

TV9 বাংলার প্রতিনিধি যখন পৌলমীর বাড়িতে, তখনও তার বাবা বিছানায় শোওয়া। পৌলমী তার বাবার মাথার শিয়রে বসা। তার বাঁ হাত, জামার হাতার মুখ দিয়ে বেরিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে। কর জোড় সে অর্থে পৌলমী করতে পারল না। তবে একটা হাতই হাত জোড় করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করল, ‘বাংলায় বোমাবাজি বন্ধ হোক। আর যেন কোনও বাচ্চার অবস্থা আমার মতো না হয়।’ পৌলমীর চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠল। তখনই পৌলমীর বাবার ফোনটা বেজে উঠল। পৌলমী বলল, ‘দেখো বাবা আবারও কেউ আশ্বাস দেবেন হয়তো?’ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বললেন, ‘যেন তাই হয়…’

Next Article