আসানসোল : আসানসোলেও রয়েছে এক বক্রেশ্বর। সেখানেও রয়েছে এক উষ্ণ প্রস্রবণ। মাটির তলা থেকে বেরিয়ে আসছে গরম জল। ২৪ ঘণ্টা অন্তত ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গরম জল বেরিয়ে আসছে। প্রকৃতির সেই আশ্চর্যের কথা জানেন না অনেকেই। স্থানীয় কিছু লোকজন এলেও পর্যটকের দেখা মেলে না। কার্যত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে আছে সেই উষ্ণ প্রস্রবণ। স্থানীয়রা চাইছেন, যাতে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করা যায়।
আসানসোলে বারাবনির জঙ্গল ঘেরা নির্জন এলাকায় মাটির নীচ থেকে গলগল করে ২৪ ঘন্টা বেরিয়ে আসে গরম জল। সেই জল প্রায় ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়ার বা ১৭০ ডিগ্রি ফারেনাইট তাপমাত্রার। যার মধ্যে চাল ফেললে সেদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জেলা প্রশাসনের অবজ্ঞা আর অবহেলায় আসানসোলের নিরালা উষ্ণ প্রস্রবণ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। উষ্ণ প্রস্রবণ দেখতে বা স্নান করতে বিক্ষিপ্তভাবে লোকজন আজও আসেন। শীতকালে বনভোজনও করতেও আসেন কেউ কেউ। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থাকলেও পানীয় জল, বিনোদনের ব্যবস্থা বা নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকদের ইচ্ছা থাকলেও সেখানে যেতে পারেন না।
বারাবনির পানিফলায় উষ্ণ প্রস্রবণটি ২০০০ সালে প্রথম নজরে আসে জেলা প্রশাসনের। ২০ বছর আগে বক্রেশ্বরের ধাঁচে সেই উষ্ণ প্রস্রবণকে ঘিরে পর্যটক টানায় উদ্যোগী হয়েছিল তৎকালীন বর্ধমান জেলা পরিষদ। বারাবনির পানিফলায় সেই উদ্দেশ্যে গড়া হয়েছিল পার্ক, জলাধার। কিন্তু বাম জামানাতেই জেলাপরিষদের অবহেলায় শেষ হয়ে যায় নিরালা পার্কটি।
মাটি থেকে গরম জল বেরিয়ে আসত পানিফলা গ্রামে। ভিড় জমতে থাকত এলাকায়। এরপরেই জায়গাটিকে পর্যটন কেন্দ্র গড়তে উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন জেলা পরিষদ। পানিফলা গ্রামের ১৯ জনের দান করা জমি ও কিছু খাস জমিতে গড়ে ওঠে ওই পর্যটন কেন্দ্রটি। গ্রামবাসীদের আশা ছিল, পর্যটনকে ঘিরে অর্থনীতি পাল্টে যাবে এলাকার। বর্ধমান জেলা পরিষদের উদ্যোগে নির্মিত নিরালা উষ্ণ প্রস্রবণটির উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন পর্যটনমন্ত্রী দীনেশচন্দ্র ডাকুয়া।
উষ্ণ প্রস্রবণ জল ধরে রাখতে স্নান করার জন্য একটি চৌবাচ্চা তৈরি হয়। শিশুদের জন্য পার্ক বা খেলার ব্যবস্থা, জলাধারে নৌকাবিহারের ব্যবস্থাও করা হয়। পাঁচিলের মাঝে কৃত্রিম পাহাড়, এমনকী ভাড়া দেওয়ার জন্য ডর্মিটরি বা ছোট কটেজও তৈরি করা হয়। এ সবের দেখভাল করার জন্য চুক্তির ভিত্তিতে ঠিকাদার সংস্থাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সেই নিরালা উষ্ণ প্রস্রবণের এখন কঙ্কালসার চেহারা। সদর দরজায় লোহার অংশ খুলে নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। টিকিট কাউন্টারের সব জিনিসপত্রও খোয়া গিয়েছে। উধাও হয়ে গিয়েছে পর্যটন কেন্দ্রের নাম লেখা ফলকটিও। কোনও ঠিকা সংস্থার কর্মী বা নিরাপত্তারক্ষীরাও থাকেন না সেখানে।
বাম জামানার অবসান ঘটে তৃণমূল সরকার এলেও গত ১০ বছর ধরে নিরালা উষ্ণ প্রস্রবণ নিয়ে কোনও উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি জেলা প্রশাসনকে। তবে সেখানে এখনও স্থানীয়রা যান। শীতকালে বহু মানুষ গরম জলের চৌবাচ্চায় স্নান করতে যান। কেউ খেলাধূলা করে, কেউ বা মাঠের কাজ করে। কেউ আবার যান হাতে পায়ের ব্যাথা দূর করার জন্য। এবার দাবি উঠেছে আবারও সেজে উঠুক উষ্ণ প্রস্রবণ। পর্যটনের হাত ধরে আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উন্নতি হোক বারাবনির প্রান্তিক এলাকা পানিফলার। তবে বিধায়ক ও পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে উষ্ণ প্রস্রবণ সংস্কারের জন্য পশ্চিম বর্ধমান জেলা প্রশাসন দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যা দিয়ে ভেঙে পড়া পাঁচিল সংস্কারের কাজ হচ্ছে। ধীরে ধীরে কটেজ ও রেস্তোরাঁও তৈরি হবে সেখানে। জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের অর্থ তহবিলেও নতুন করে সেজে উঠবে আসানসোলের বক্রেশ্বর।
বারাবনির বিধায়ক বিধান উপাধ্যায় বলেন, ‘এই পার্কটি বাম আমলে তৈরি হয়েছিল বাম আমলেই ধ্বংস হয়ে যায়। তৎকালীন বর্ধমান জেলা পরিষদ পার্ক রক্ষণাবেক্ষণের যে টাকা দিত সে টাকা তা তারা বন্ধ করে দেয়। তবে নতুন করে এই পার্কটি সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছি। পার্কের বাইরে যে রাস্তাটি গিয়েছে লালগঞ্জ থেকে দমানি পর্যন্ত, সেটি একেবারে কাঁচা রাস্তা ছিল। ১০ কিলোমিটার এই রাস্তাটি আমরা পাকা করে দিয়েছি। ফলে শহর আসানসোল থেকে পানিফলা যাতায়াতের অনেকটাই সুবিধা হচ্ছে এখন। ইতিমধ্যে জেলা পরিষদ থেকে দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যা দিয়ে পুরো পার্কটির নতুন করে বাউন্ডারি তৈরি করা হচ্ছে। ছোট্ট একটি অফিস ঘর ইতিমধ্যে বানানো হয়েছে।’
উষ্ণ প্রস্রবণটি রয়েছে ইটাপাড়া পঞ্চায়েতের আওতায়। ওই পঞ্চায়েতের উপ প্রধান উত্তম মাজি বলেন, ‘ষাটের দশকে কোন এক প্রাইভেট কোল কোম্পানি এখানে বোরিং করে গিয়েছিলো। তাদের কাজকর্ম শেষ হওয়ার পর চলে যায়। এরপরে ওই বোরিং দিয়ে এই গরম জল বের হতে শুরু হয়। সেই যে ষাটের দশকের শুরু হয়েছে ২৪ ঘন্টা এখনও ওই জল বেরিয়ে আসছে। প্রচুর মানুষ এখানে আসেন। এই জায়গাটি আমরা পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করে তুলব।’ বিধায়ক জানিয়েছেন, পানিফলা নিরালা উষ্ণ প্রস্রবণের কাছেই রয়েছে রয়েছে মুক্তাইচন্ডী মন্দির ও পাহাড়, মন্দিরা ড্যাম ও কল্যানেশ্বরী- মাইথন। এই সবগুলো নিয়ে একটি টুর প্যাকেজ তৈরি করা হবে। যার স্বীকৃতি মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন : নিহত অভিজিৎ সরকারের দাদাকে ‘খুনের হুমকি’ মামলায় নয়া মোড়, বাড়ির এলাকা-জুড়ে বসছে সিসি ক্যামেরা