পূর্ব বর্ধমান: কারাবন্দি কৃষ্ণচন্দ্র মুক্ত হয়ে দেখলেন বাংলায় দেবী দুর্গার আরাধনাকাল অতিক্রান্ত। তাই সেই বছর থেকেই শুরু হয় কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো। ভিন্ন রূপে দেবী আরাধনার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন তিনি। পরিপাটি আর এক্কেবারে দুর্গাপূজার মেজাজে। বর্ধমানের রায়ান গ্রামের চৌধুরী পরিবারের দেবী আরাধনা ইতিহাস যেন ঠিক উল্টো। স্বপ্নাদেশ পেয়ে শুরু দুর্গাপূজার। তার আগে অবশ্য জগদ্ধাত্রী পুজোর চল ছিল।
স্মৃতির পাতা উল্টে দেখে নেওয়া যাক ইতিহাস
৩৫৬ বছরের ইতিহাস নিয়ে আজও জমকালো দুর্গাপুজো। যুগের নিয়মে সামান্য কিছু রীতিনীতির বদল হলেও কৌলিন্য এবং জাঁকজমক অটুট বর্ধমান এক নম্বর ব্লকের রায়ান গ্রামের চৌধুরী পরিবারের শারদ পর্ব। বিখ্যাত এই পুজোতে এক সময় এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কুমুদ রঞ্জন ঘোষ, আশাপূর্ণা দেবীর মত ব্যক্তিত্বরা।
পারিবারিক ইতিহাস বলে, পরিবারের প্রাণপুরুষ বর্ধমান রাজ পরিবারের নায়েক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তৎকালীন বর্ধমান মহারাজের নায়েক কাশীনাথ চৌধুরী স্বপ্নাদেশ পান দুর্গাপুজো করার। তার আগে অবশ্য এই পরিবার মেতে উঠত জগদ্ধাত্রী আগমনে। রথযাত্রার দিন কাঠামোর গায়ে মাটি দিয়ে শুরু হয় প্রতীক্ষার পালা। বৈদিক মতে পুজো শুরু হয় পঞ্চমী থেকে। রীতির মধ্যে থাকে দেবী ঘট, গণেশ ঘট, নবপত্রিকাঘটের উত্তোলন। সেই সঙ্গে থাকে নবমীতে কুমারীপুজো। বিসর্জনেও রয়েছে বিশেষ রীতি।
ঠাকুরদালানের একদিক দিয়ে বেরিয়ে আসেন দেবী দুর্গা, অন্য দুয়ার থেকে প্রবেশ করেন সমৃদ্ধির দেবী লক্ষী। উৎসবের কালে ফাঁকা মন্দির থাকে না চৌধুরী পরিবারে। আগে অবশ্য বলি প্রথাও ছিল। কিন্তু ৫০ বছর আগে কুলপুরোহিত স্বপ্নদোষ পান বন্ধ করতে হবে এই প্রথা। এখন শুধুমাত্র দেবীর পাশে সিঁদুর দিয়ে ইতি টানা হয়েছে বলিতে।
চৌধুরীবাড়ির বর্তমান সদস্যদের সংখ্যা প্রায় আশি। অনেকেই কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। তবে পুজো এলে এক বিন্দুতে মেলে গোটা পরিবার। লক্ষ্মী ঠাকুরের বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে চলে উৎসব। গোটা গ্রাম সামিল হয় এই একটি মাত্র পুজোকে কেন্দ্র করেই। তাই নবমীর দিনে প্রায় পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষ পাত পেড়ে খাওয়া-দাওয়া সারেন চৌধুরী বাড়িতে। আভিজাত্যের শেষ নেয় এখানেই। বাংলার প্রাচীন অভিজাত পরিবারগুলির মত চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজোতেও বংশ পরম্পরায় বায়না ধরা রয়েছে পুরহিত, ঢাকি, প্রতিমাশিল্পীদের।
পুজোর এই বিরাট খরচ চলে কীভাবে?
পরিবারের সদস্যরা জানাচ্ছেন, বর্ধমান রাজপরিবার থেকে বেশ কিছু জমি জমা এবং পুকুর দান করা হয়েছিল তাঁদের। সেই জমি এবং পুকুর থেকে আসা টাকাতেই চলে পুজোর বিশাল খরচ।
প্রসঙ্গত, যুগের গতিতে বাংলার সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে বহু আভিজাত্য পুজো। তারই মাঝে কৌলিন্য, পারিবারিক নীতি, আভিজাত্য নিয়ে বেঁচে থাকা পুজো গুলির মধ্যে অন্যতম বর্ধমানের চৌধুরী পরিবারের শারদীয়া।