পূর্ব বর্ধমান: জন্মের পর যখন প্রথমবার মাকে সন্তানের মুখ দেখানো হল মূর্ছা গিয়েছিলেন জন্মদাত্রী। একরত্তি তুলতুলে ছেলে, কী মায়ায় ভরা মুখখানা, অথচ দু’টো হাত নেই। সে সময় অনেকেই বলেছিলেন, ‘ও ছেলে মেরে ফেল। না হলে বিপদ বাড়বে’। মা-বাবা পারেননি! ১০ মাস ১০ দিন যাকে নিজের শরীরে মা বড় করেছে, তার প্রতি কি আর এত কঠিন হওয়া যায়? বুকের ওমে মা তাকে বড় করে, সবসময় পাশে থেকেছে বাবা। সেই ছেলে দেখতে দেখতে বড় হল। পড়াশোনা করে, আইটিআই পাশ করে এখন ট্রাক্টর চালান। পূর্ব বর্ধমানের রায়নার প্রত্যন্ত উচালন গ্রামের বাসিন্দা বছর সাঁইত্রিশের সুজিত দাঁ সত্যিই অনুপ্রেরণা। আর তাঁর মা পুতুলদেবী, তাঁর পরিবার নজির।
সুজিতদের যৌথ পরিবার। খুব ছোট বয়সেই বাবা স্বপন দাঁকে হারান তিনি। তবে মা আর বাড়ির অন্যান্যরা তাঁকে বুকে আগলে বড় করেন। আর সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে বেঁচে থাকার রসদ তাঁকে অনবরত যিনি জুগিয়ে গিয়েছেন, তিনি তাঁরই গ্রামের মাষ্টারমশাই শক্তিপদ ভট্টাচার্য। ছেলের হাত নেই তো কী, মাষ্টারমশাই পায়ের আঙুলে পেন্সিল গুঁজে লিখতে শেখান সুজিতকে। সেই যে কোন ছোট্ট বয়সে পায়ের আঙুলে পেন্সিল গুঁজে লেখাপড়া শুরু, এরপর একে একে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আইটিআই (ITI) সার্ভে ডিপ্লোমা কোর্সও করেন। ডিভিসিতে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখে পরীক্ষাও দেন। নাম উঠেছিল প্যানেলে। কিন্তু ২০১১ সালের পর সেই প্যানেল যে কোথায় গেল সুজিত জানতে পারেননি আজও।
কতদিন আর বসে থাকবেন। এরপর যে দু’পায়ে ভর করে লেখাপড়া শেখেন, সেই দুই পায়ের জোরেই শিখে নিলেন ট্রাক্টর চালানো। এখন তা চালিয়েই অন্নসংস্থান করেন। সঙ্গে ধানের ব্যবসাও রয়েছে। সম্প্রতি খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে গাড়ির স্পেয়ার পার্টসের ব্যবসাও শুরু করেছেন। দোকানে খরিদ্দার এলে পায়ে করেই তাঁদের জিনিস এগিয়ে দেন। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ব্যবহারও করেন পায়ের সাহায্যেই। তবে এখনও বাড়ি থাকলে মায়ের হাতেই খাবার খান সুজিত। না হলে চামচে করে পা দিয়েই খেতে হয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে বেশ সক্রিয় এই যুবক। খাওয়া দাওয়া করতে সমস্যা হয় না?এর উত্তরে সুজিত জানান ,বাড়িতে থাকলে মা খাইয়ে দেন।বাইরে থাকলে চামচ পায়ের আঙুল দিয়ে ধরে নিয়ে খাবার তুলে খান।
সুজিত দাঁ বলেন, “আমি তো জন্ম থেকে এভাবে বড় হয়েছি। আমার মা, বাবা, কাকারা সবসময় উৎসাহ দিয়েছে। আর আমার গ্রামের মাস্টারমশাইয়ের কথা না বললেই নয়। উনিই আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। উনিই পা ধরে লেখা শিখিয়েছেন। আমার একটাই আর্জি, সরকার যদি পঞ্চায়েত হোক বা বিডিও অফিস হোক কোথাও একটা স্থায়ী চাকরি দেয়। আমার তো না হলে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়। পিওন হোক, গেটম্য়ান হোক, কিন্তু কাজটা স্থায়ী হোক।”
মা পুতুল দাঁ এখনও সেইদিনের কথা মনে করলে গলা বুজে আসে। নিজেই বললেন, “আমাকে প্রথম যেদিন দেখাল আমি তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ওর ১৫-১৬ বছর যখন বয়স, মাধ্যমিক দেবে বাবা মারা গেল। সেই থেকে লড়াই চলছে। তবে ছেলেটা স্বাবলম্বী, এটা গর্বের। অন্যদেরও ও লড়াইয়ের সাহস জোগায়।”