পুরুলিয়া: নিকষ অন্ধকারের বুক চিড়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। দুলন্ত কামরার অবিরাম খটখট আওয়াজের মাঝে ভেসে আসছে কোনও এক জনৈকের সুরেলা গলায় এই গান, ‘প্যারে নন্দকে কিশোর/ চলো কুঞ্জকে ওর দেখো/ নব ঘনঘোর ঘিরি আয়ে বদরি’। এই সুর শুনে আধো ঘুম চোখে যাত্রীদের কৌতূহল জাগতেই পারে জনৈককে এক পলক দেখার। আপার বাথে শুয়ে গান বেঁধেছে সে। গালে কয়েকদিন না কামানো দাড়ি, পরনে সাদা শার্ট, বুক অবধি কম্বল টেনে নির্লিপ্তভাবে সুরে ভাঁজ দিচ্ছে সে। বার্থের রেলিংয়ের সঙ্গে তার বাঁ-হাতটি হাতকড়া লাগানো। চোখে না পড়লে কে বলবে কয়েকদিন আগে নৃশংস খুন করে সোজা উত্তর প্রদেশে গা ঢাকা দিয়েছিল সে। চার দিকে সাদা উর্দিধারী। তারাও মনমুগ্ধ তান্ত্রিক সনাতন ঠাকুরের গানে। ২০১৭ সালে ৩১ জুলাই হাতকড়া পরিয়ে এভাবেই শিশুকন্যা খুনে দোষী সাব্যস্ত সনাতন ঠাকুরকে ট্রেনে করে নিয়ে এসেছিল বাংলার পুলিশ।
২০১৭ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে পুরুলিয়ায় দেবেন মাহাত সদর হাসপাতালে সর্দি কাশির সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয় এক সাড়ে তিন বছরের শিশুকন্যা। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তাররা শিশুটিকে পরীক্ষা করে চমকে ওঠেন। সারা শরীরে ক্ষত, বুকের কাছে চলটা ওঠা, হাত পা ফোলা, এমনকী যৌনাঙ্গেও গভীর ক্ষত। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেন পুলিশ এবং চাইল্ড লাইনের সঙ্গে। সে সময় পুলিশ খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও চাইল্ড লাইন খোঁজ খবর করতে শুরু করে। ততক্ষণে ডাক্তারদের কাছে আরও চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে। শিশুটিকে গভীর পর্যবেক্ষণ করতে এক্সরে করা হয়। আর সেই এক্সরে প্লেটই ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শিশুটির শরীরের ভেতর বিশাল সাইজের সাত সাতটি সূচ ঢুকে আছে। এবং শিশুটি যৌন হেনস্থার শিকারও। সংবাদ মাধ্যমে সে খবর প্রকাশিত হতেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। শুরু হয় তদন্ত।
বাষট্টি বছরের সনাতন অবসরের পর পুরুলিয়া -বাঁকুড়ার বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে কীর্তন গাইবার পাশাপাশি ওঝাগিরি করত। ওই শিশুটির মায়ের বাবার বন্ধু বলে জানা যায় সনাতন। ওই মহিলাকে পাশের গ্রামে বিয়েও দেয় সনাতনই। কিন্তু বিয়ে টিকিয়ে রাখতে পারেনি ওই মহিলা। সনাতনের প্রেমে পড়ে সে। স্বামীকে ছেড়ে সাড়ে তিন বছরের সন্তানকে নিয়ে এসে ওঠে সনাতনের বাড়িতে। একসঙ্গে সহবাস করতে থাকে। নিজের সন্তানকে পছন্দ করত না সে। আর সনাতনের সঙ্গে মিলে ওই শিশুকে যৌন খেলনা হিসেবে ব্যবহার করত। সঙ্গে চলত ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চাও। এ সবই তত্ত্ব জেরায় ওই মহিলা জানায়।
ঘটনা জানাজানি হতেই এলাকা ছেড়ে পালায় সনাতন। তার বিরুদ্ধে ২০১২ পকসো আইনে ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণ, ৩২৬ ধারায় শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ৩০৭ ধারায় খুনের চেষ্টা এবং ৩০২ ধারায় খুনের মামলা রুজু হয়। উত্তর প্রদেশের রেনুকোট পিপড়ি গ্রামে স্থানীয় রাধা কৃষ্ণ মন্দিরে সাধু সেজে ছিল সনাতন৷ সেখান থেকেই ২২ জুলাই ২০১৭য় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আস্তে আস্তে খোলসা হতে থাকে বিকৃতকাম সনাতনের কুদৃষ্টি পড়েছিল নিজের বড় বৌমা এবং তার কন্যা সন্তানের দিকেও। কিন্তু অশান্তি করে আলাদা হয়ে যায় সে। গ্রামে গঞ্জে ঘুরে নিজের গানে মহিলাদের মোহিত করে নিজের প্রেমের ফাঁদে ফেলত সনাতন। সেই সময় সনাতনকে নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিস্তর রায় প্রকাশ পেয়েছিল। কারও মতে ব্ল্যাক ম্যাজিক করত সনাতন, কারও মতে যৌন বিকৃতির শিকার সে, আবার কেউ কেউ রায় দিয়েছিলেন মাল্টি ডিজঅর্ডার পার্সোনালিটিরও। কিন্তু সনাতনের এমন আচরণের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কেউই।
সনাতনার পাশাপাশি গ্রেফতার হয় শিশুটির মাও। ৫৭ দিন ধরে তদন্তের পর ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে ঘটনার চার্জশিট দাখিল করে পুরুলিয়া থানার পুলিশ। তারপর দীর্ঘ চার বছর ধরে বিচার চলার পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ শুক্রবার পুরুলিয়া জেলা আদালতে রমেশকুমার প্রধানের এজলাসে দোষী প্রমাণিতত হয় দুজনেই। আজ সোমবার শাস্তি ঘোষণা করবেন বিচারক।
আরও পড়ুন: Post Poll Violence Case: ভোর রাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে সিবিআই-এর হানা, আটক পলাতক তৃণমূল কর্মীর ছেলে
পুরুলিয়া: নিকষ অন্ধকারের বুক চিড়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। দুলন্ত কামরার অবিরাম খটখট আওয়াজের মাঝে ভেসে আসছে কোনও এক জনৈকের সুরেলা গলায় এই গান, ‘প্যারে নন্দকে কিশোর/ চলো কুঞ্জকে ওর দেখো/ নব ঘনঘোর ঘিরি আয়ে বদরি’। এই সুর শুনে আধো ঘুম চোখে যাত্রীদের কৌতূহল জাগতেই পারে জনৈককে এক পলক দেখার। আপার বাথে শুয়ে গান বেঁধেছে সে। গালে কয়েকদিন না কামানো দাড়ি, পরনে সাদা শার্ট, বুক অবধি কম্বল টেনে নির্লিপ্তভাবে সুরে ভাঁজ দিচ্ছে সে। বার্থের রেলিংয়ের সঙ্গে তার বাঁ-হাতটি হাতকড়া লাগানো। চোখে না পড়লে কে বলবে কয়েকদিন আগে নৃশংস খুন করে সোজা উত্তর প্রদেশে গা ঢাকা দিয়েছিল সে। চার দিকে সাদা উর্দিধারী। তারাও মনমুগ্ধ তান্ত্রিক সনাতন ঠাকুরের গানে। ২০১৭ সালে ৩১ জুলাই হাতকড়া পরিয়ে এভাবেই শিশুকন্যা খুনে দোষী সাব্যস্ত সনাতন ঠাকুরকে ট্রেনে করে নিয়ে এসেছিল বাংলার পুলিশ।
২০১৭ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে পুরুলিয়ায় দেবেন মাহাত সদর হাসপাতালে সর্দি কাশির সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয় এক সাড়ে তিন বছরের শিশুকন্যা। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তাররা শিশুটিকে পরীক্ষা করে চমকে ওঠেন। সারা শরীরে ক্ষত, বুকের কাছে চলটা ওঠা, হাত পা ফোলা, এমনকী যৌনাঙ্গেও গভীর ক্ষত। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেন পুলিশ এবং চাইল্ড লাইনের সঙ্গে। সে সময় পুলিশ খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও চাইল্ড লাইন খোঁজ খবর করতে শুরু করে। ততক্ষণে ডাক্তারদের কাছে আরও চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে। শিশুটিকে গভীর পর্যবেক্ষণ করতে এক্সরে করা হয়। আর সেই এক্সরে প্লেটই ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শিশুটির শরীরের ভেতর বিশাল সাইজের সাত সাতটি সূচ ঢুকে আছে। এবং শিশুটি যৌন হেনস্থার শিকারও। সংবাদ মাধ্যমে সে খবর প্রকাশিত হতেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। শুরু হয় তদন্ত।
বাষট্টি বছরের সনাতন অবসরের পর পুরুলিয়া -বাঁকুড়ার বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে কীর্তন গাইবার পাশাপাশি ওঝাগিরি করত। ওই শিশুটির মায়ের বাবার বন্ধু বলে জানা যায় সনাতন। ওই মহিলাকে পাশের গ্রামে বিয়েও দেয় সনাতনই। কিন্তু বিয়ে টিকিয়ে রাখতে পারেনি ওই মহিলা। সনাতনের প্রেমে পড়ে সে। স্বামীকে ছেড়ে সাড়ে তিন বছরের সন্তানকে নিয়ে এসে ওঠে সনাতনের বাড়িতে। একসঙ্গে সহবাস করতে থাকে। নিজের সন্তানকে পছন্দ করত না সে। আর সনাতনের সঙ্গে মিলে ওই শিশুকে যৌন খেলনা হিসেবে ব্যবহার করত। সঙ্গে চলত ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চাও। এ সবই তত্ত্ব জেরায় ওই মহিলা জানায়।
ঘটনা জানাজানি হতেই এলাকা ছেড়ে পালায় সনাতন। তার বিরুদ্ধে ২০১২ পকসো আইনে ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণ, ৩২৬ ধারায় শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ৩০৭ ধারায় খুনের চেষ্টা এবং ৩০২ ধারায় খুনের মামলা রুজু হয়। উত্তর প্রদেশের রেনুকোট পিপড়ি গ্রামে স্থানীয় রাধা কৃষ্ণ মন্দিরে সাধু সেজে ছিল সনাতন৷ সেখান থেকেই ২২ জুলাই ২০১৭য় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আস্তে আস্তে খোলসা হতে থাকে বিকৃতকাম সনাতনের কুদৃষ্টি পড়েছিল নিজের বড় বৌমা এবং তার কন্যা সন্তানের দিকেও। কিন্তু অশান্তি করে আলাদা হয়ে যায় সে। গ্রামে গঞ্জে ঘুরে নিজের গানে মহিলাদের মোহিত করে নিজের প্রেমের ফাঁদে ফেলত সনাতন। সেই সময় সনাতনকে নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিস্তর রায় প্রকাশ পেয়েছিল। কারও মতে ব্ল্যাক ম্যাজিক করত সনাতন, কারও মতে যৌন বিকৃতির শিকার সে, আবার কেউ কেউ রায় দিয়েছিলেন মাল্টি ডিজঅর্ডার পার্সোনালিটিরও। কিন্তু সনাতনের এমন আচরণের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কেউই।
সনাতনার পাশাপাশি গ্রেফতার হয় শিশুটির মাও। ৫৭ দিন ধরে তদন্তের পর ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে ঘটনার চার্জশিট দাখিল করে পুরুলিয়া থানার পুলিশ। তারপর দীর্ঘ চার বছর ধরে বিচার চলার পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ শুক্রবার পুরুলিয়া জেলা আদালতে রমেশকুমার প্রধানের এজলাসে দোষী প্রমাণিতত হয় দুজনেই। আজ সোমবার শাস্তি ঘোষণা করবেন বিচারক।
আরও পড়ুন: Post Poll Violence Case: ভোর রাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে সিবিআই-এর হানা, আটক পলাতক তৃণমূল কর্মীর ছেলে