জয়নগর: ভৌগোলিক দিক থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। দুটোই প্রত্যন্ত গ্রাম। মাটির বাড়ি, দিন আনা দিন খাওয়া দেহাতি মানুষের বাস। এক জয়নগরের দোলুয়াখাঁটি গ্রাম, আরেকটি রামপুরহাটের বগটুই। কালীপুজোর পরের ভোরটা ফেরাল বগটুইয়ের স্মৃতি। নৃশংসতার প্রেক্ষিতে বিচার করলে বগুটুই অবশ্য এগিয়ে। কারণ সেখানে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল একাধিক প্রাণ। কিন্তু দোলুয়াখাঁটিও যে কোনও সময়ে বগটুই হতেই পারত। আর তা হওয়ার সমস্ত উপকরণই ছিল। কারণ প্রেক্ষিত ছিল এক, অর্থাৎ তৃণমূল নেতা খুন, আর তৎপরবর্তী পরিস্থিতি, অর্থাৎ খুন হওয়া নেতার অনুগামীদের তাণ্ডবলীলা। সেই গ্রামে বেপরোয়া লুঠপাট, গোটা গ্রামে পরপর বাড়ি জ্বালানো। কিন্তু একাধিক প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হয়েছে, আর তার নেপথ্যে কাজ করেছে সময়ের ফারাক। বগটুইয়ে তাণ্ডব চলেছিল মধ্যরাতে, আর দোলুয়াখাঁটিতে দিনে। যে সময়ে অন্তত লোকে জেগে রয়েছেন, তাই বিপদ আঁচ করতে পেরে আগে থেকেই ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, বেরিয়ে এসেছেন।
বগটুইয়ে মধ্যরাতে একের পর এক বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশ, দমকল কর্মীদের পৌঁছানোর অভিযোগ ওঠে। ততক্ষণে যা হওয়ায় হয়ে গিয়েছে। আর দোলুয়াখাঁটির ক্ষেত্রেও তেমনি। ভোর পাঁচটা ১০ মিনিটে নমাজ পড়তে যাওয়ার সময়ে গুলি করে খুন করার অভিযোগ ওঠে সইফুদ্দিন লস্কর। তখনই এক অভিযুক্তকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে। আরেক অভিযুক্ত ধরাও পড়ে যায়। কিন্তু নিহত সইফুদ্দিনের অনুগামীদের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে দোলুয়াঘাঁটি গ্রামের একটি জনপদের ওপর। কারণ প্রথম থেকেই এই খুনের ঘটনায় তৃণমূলের পক্ষ থেকে সিপিএমের দিকে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। আর যে জনপদের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা বর্তমানে কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও, এক সময়ে সিপিএম করতেন কিংবা সিপিএমকে সমর্থন করতেন। আর গোটা ক্ষোভ, রোষের শিকার হলেন তাঁরাই।
গ্রামের ২০-২৫টা বাড়িতে চলে বেপরোয়া লুঠপাট। হাড়ি, ঘটি, কড়াই, চাল, জামাকাপড়-কিচ্ছু বেচে নেই। সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়েছে লুঠপাট, আগুন লাগানো। তাণ্ডবলীলা চলেছে ঘণ্টা দেড়েক। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ গ্রামে ঢুকে যতদূর পর্যন্ত চোখ গিয়েছে, দেখা গিয়েছে আগুন জ্বলছে। বাইরে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছেন বাসিন্দারা। কোলে দুধের শিশু, তাকে খাওয়ানোর দুধও পুড়ে কালচিটে ছাই।
এক মহিলা বললেন, “সকালে মার্ডারটা হল। গ্রামে খবর এল। তখনও কিছু বুঝিনি। হঠাৎ করেই দলবল ঢুকে পড়ল গ্রামে। ভাঙচুর চালাল তৃণমূলের লোকেরা। আমরা খেটেখাওয়া মানুষ। সব পুড়ে গিয়েছে। হাড়ি, চাল, কাপড় সব পুড়েছে। আটটা থেকে তাণ্ডব চলেছে। চোখের সামনে আমাদের ঘরে আগুন লাগিয়েছে। প্রাণের ভয়ে প্রথমে নেভাতেও যেতে পারিনি। ওরা গেলে ছাই হাতড়েছি। আমরা সিপিএম করতাম, এখন কোনও দল করি না।”
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, সাড়়ে তিন ঘণ্টা পর গ্রামে ঢুকেছে দমকল। এক্ষেত্রেও দমকল কর্মীদের আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে। দমকল ঢুকে যতক্ষণে জল দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছেন, ততক্ষণে তো সবই কালো ছাই! গ্রাম আপাতত পুরুষশূন্য। তবে এক দু’জন ক্যামেরার সামনে মুখ খুলেছেন। এক যুবক বললেন, “সকাল সাড়ে সাতটা থেকেই শুরু হয়েছে এসব। আর দমকল এসেছে ১১টা নাগাদ। ততক্ষণে আমাদের যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ”
কিন্তু কেন তাঁরা টার্গেট? কারণ নিহতের বাবা একবার মুখ থেকে বার করেছেন, তাঁর ছেলের মৃত্যুর জন্য সিপিএম দায়ী, আর স্ত্রীও। একই দাবি করেছেন ক্যানিং পূর্বে বিধায়ক সওকত মোল্লাও। একপর কোনও তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই কেবল সন্দেহের বশেই গোটা গ্রামে আগুন ধরিয়েছেন সইফুদ্দিনের অনুগামীরা। যেমনটা অন্তত হয়েছিল বগটুইয়ের ক্ষেত্রেও। প্রাণ গিয়েছিল নিরীহ কিশোরেও। এক্ষেত্রে দিনের আলোয় গোটা ঘটনা হওয়ায় নৃশংসতা এড়ানো গিয়েছে। কিন্তু ভয়াবহতা সেই একই।
কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই সেই গ্রামের কেউ! এক মহিলা বললেন, “কিচ্ছু নেই। গায়ে আমাদের যে জামাকাপড় রয়েছে, তা ছাড়া আর কেউ নেই। বাচ্চাটাকে ঠান্ডায় কী পরাব জানি না।” আরেক মহিলা বলেন, “ভয়ঙ্কর সে ছবি। আমাদের ঠেলে সরিয়ে আগুন জ্বালাল ওরা। আমরা সিপিএম করি বলে। গোটা পাড়া আমাদের জ্বলছিল।” সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বললেন, “সন্দেহের বশে এসব। কারোর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে না দিয়ে খুনিকে বার করা হোক।”