কুলতলি: সোমবার ভরদুপুর। হঠাৎ করেই কুলতুলির প্রত্যন্ত গ্রাম পয়তারাহাট উঠে আসে খবরের শিরোনামে। দুষ্কৃতী ধরতে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু গ্রামের সরু গলিতে পুলিশের ভ্যান ঢুকতেই ধেয়ে আসে গুলি। চরম উত্তেজনার পরিস্থিতি। নকল সোনা ও মূর্তি পাচারের অভিযোগে তদন্তে নেমে সাদ্দার সর্দার নামে এক যুবকের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু খেতে হল গুলি। উত্তেজনার মুহূর্তের মধ্যে ‘টার্গেট’ সাদ্দাম হয়ে যান হাওয়া। আর তার বদলে পুলিশের সামনে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন দুই মহিলা। পুলিশ তাঁদেরকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। আসলে ওই দুই মহিলা সাদ্দাম সর্দার ও তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী। পুলিশের হাত থেকে স্বামীদের বাঁচাতে তাঁরাই সামনে আসেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত পুলিশ আঁচ করতে পারেনি, এ জল কতদূর গড়াবে।
সাদ্দামের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। আর সেই বাড়িতেই পরতে পরতে রহস্য। বাড়ির বেডরুমে স্টিলের খাট। আলমারি, সোকেস-সবই চলছে তল্লাশি। কিন্তু সাদ্দামের শোওয়ার ঘরের খাট সরাতেই এ কী! সুড়ঙ্গ। বেড রুমে সুড়ঙ্গ, আর সেই সুড়ঙ্গ মিশেছে খালে, আর সেই খাল গিয়ে পড়েছে নদীতে। অর্থাৎ বেড রুম থেকে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় মাতলা নদীতে। সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়েছিল TV9 বাংলা। দেখা যায়, খালে ভাসছে নৌকোর মতো লোহার ট্রে। সেই ট্রে-র দুপাশে হাতল, তাতে লাগানো দড়ি। সুড়ঙ্গের হদিশ মিলতেই সাদ্দাম রাতারাতি হয়ে ওঠেন সুড়ঙ্গম্যান। কিন্তু সাদ্দামের এই সব তথ্য এতদিনে এক ফোঁটাও টের পাননি প্রতিবেশীরা। কেবল চাষা-ভুষো মানুষ হিসাবেই চিনতেন তাঁরা। সেই সাদ্দামই নাকি সোনা পাচারে অভিযুক্ত। এই যে বাড়ির মধ্যে সুড়ঙ্গ, পুলিশের কথায়, এর একটা অবস্থানগত ব্যাখ্যা ছিল। কারণ খুব সহজেই বাড়ির নীচ থেকে সুড়ঙ্গ দিয়ে খাল পেরিয়ে নদীতে পড়লেই পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়া সম্ভব হবে।
সাদ্দামের বিরুদ্ধে আগেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এবারের অভিযোগ নদিয়ার রানাঘাটের এক ব্যবসায়ীর। নকল সোনার মূর্তি দিয়ে ১২ লক্ষ টাকার প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। আর সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই তদন্তে নেমে সাদ্দামকে গ্রেফতার করতে গিয়েছিল পুলিশ। আর তাতেই কেঁচো খুঁড়তে কেউটে।
কী ভাবে চলত সাদ্দামদের কারবার?
পুলিশ সূত্রে খবর, কোনও ধাতব মূর্তি বা বিভিন্ন প্রাচীন জিনিসপত্র দেখিয়ে এই প্রতারক দল প্রথমে ক্রেতা জোগাড় করত। আর সেক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ব্যবহার করা হত গ্রামের সাধারণ মানুষদের। তাঁদের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলা হত, নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে ওই মূর্তিগুলি তাঁরা কুড়িয়ে পেয়েছেন । এরপর সেই মূর্তির যে কোনও একটি অংশ খাঁটি সোনা ব্যবহার করা হত। ক্রেতাদের যখন সোনা যাচাই করতে দেওয়া হত, তখন কেবল মূর্তির ওই অংশটুকুই দেখানো হত। এরপর ক্রেতা দেখে মূর্তি কিনতে রাজি থাকলে নগদ টাকা নিয়ে পয়তারাহাটে আসতে বলা হত। পয়তারাহাটে এলেই টাকা পয়সা হাতিয়ে চম্পট দিত সাদ্দামের দল। আর সেই একাধিক জনের সঙ্গে করেছেন বলে অভিযোগ। কিন্তু যাঁরা প্রতারিত হতেন, তাঁদের অধিকাংশই পুলিশি কেস কিংবা পাচারের কেসে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে থানা পর্যন্তও যেতেন না। সাদ্দামের অন্যতম সঙ্গী হিসাবে হাত কাটা বোটো ও ছাকাতের নাম। বোমায় হাত উড়ে গিয়েছিল বোটোর।
কীভাবে চক্র সক্রিয়?
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গোচরণ দক্ষিণ বারাসাত জয়নগরে যখন এক ধরনের এজেন্ট রয়েছে তার পাশাপাশি কলকাতা শহরে এমনকি ভিন রাজ্যে মুম্বাই দিল্লি পুনের মতো বড় বড় শহরেও এজেন্টরা রয়েছে। ওই এলাকায় ২০-২২ বছর ধরে এই ধরনের চক্র সক্রিয়। একা সাদ্দাম নয়, এরকম অনেক সাদ্দাম ছড়িয়ে রয়েছে ওই এলাকায়। তারা যখন ক্রেতার হদিস পায় যাঁরা অ্যান্টিক কিনতে চাইছেন বা প্রসপেক্টিভ ক্রেতা পান, তখনই তারা তাঁদের নীচের তলার এজেন্ট কে যোগাযোগ করেন। ধাপে ধাপে সাদ্দামদের লেভেল পর্যন্ত পৌঁছয়।
সাদ্দাম-পর্বের সমাপতন
অতঃপর বুধবার মধ্যরাতে সাদ্দাম-পর্বের সমাপতন। বুধবার গভীর রাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কুলতলির সাদ্দাম সর্দার। চুপড়িঝাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা থেকে সাদ্দামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নকল সোনা প্রতারণা চক্রের অন্যতম পাণ্ডা সাদ্দাম মাছের ভেড়ির চালাঘরে লুকিয়ে ছিল। কুলতলির ঝুপড়িঝাড়ার বানীরধল এলাকায় একটি মাছের ভেড়ির আলাঘর থেকে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। বুধবারও পুলিশকে দেখে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সাদ্দাম। কিন্তু এবার আর সুবিধা করতে পারেনি।