নতুন বছর। কোথায় আনন্দে-উৎসবে মেতে থাকবে, তা নয়, আতঙ্কেই কাঁটা সবাই। ২০২০ সালের স্মৃতি যে এখনও তাজা। করোনা সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালে থমকে গিয়েছিল গোটা বিশ্বই। লকডাউনে ঘরবন্দি হয়েছিলেন সকলে। কোটি কোটি মানুষ করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছিলেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই করোনা ভাইরাসের উৎস ছিল চিন। সেখান থেকেই বিশ্বজুড়ে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। ৫ বছর পর ফের ভাইরাস আতঙ্ক ফিরছে। এবার করোনা নয়, হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (Human Metapneumovirus) হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছে চিনে। হাসপাতালগুলিতে রোগীদের ভিড়। সকলের মুখে মাস্ক। ঠিক যে চিত্রটা ২০২০ সালে দেখা গিয়েছিল। পড়শি দেশে সংক্রমণ ছড়াতে স্বাভাবিকভাবেই এদেশেও নয়া ভাইরাস নিয়ে চিন্তা বেড়েছে। কিন্তু এই এইচএমপিভি কী? এর উপসর্গই বা কী?
মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে প্রথম হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের খোঁজ মেলে। এটি নিউমোভিরিডে ভাইরাস পরিবারের অংশ। এই ভাইরাসের সংক্রমণের স্থায়িত্ব সাধারণত ৩ থেকে ৬ দিন হয়। তবে সংক্রমণের গুরুতর হলে, রোগের স্থায়িত্বও বাড়ে। এইচএমপিভি সংক্রমণ থেকে ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া হতে পারে।
হিউম্য়ান মেটানিউমোভাইরাস ও কোভিড-১৯-র উপসর্গ অনেকটাই এক। দুই ভাইরাস সংক্রমণেই শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা হয়। জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ধরা, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা যায়। চিনে এই ভাইরাস সম্প্রতিই বাড়াবাড়ির আকার নিয়েছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার ব্য়াপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব কিন্তু আগেও ছিল। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ভাইরোলজি জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় তুলে ধরা হয় যে করোনা সংক্রমণের পর থেকেই চিনে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে। বিশেষ করে হেনান প্রদেশে। ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ৫ জুনের মধ্যে প্রতিদিনই এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তকরণ ও হাসপাতালে রোগী ভর্তি হওয়ার তথ্য মিলেছে।
হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস হল এমন এক ভাইরাস, যার উপসর্গ সাধারণ ঠান্ডা লাগার মতোই। সর্দি-কাশি, গলা ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয় ভাইরাস সংক্রমণে। করোনার মতোই এই ভাইরাসও শিশু ও প্রবীণদের জন্য মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এছাড়াও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রেও সংক্রমণ হলে তা বাড়াবাড়ি আকার নেবে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ভাইরাসে ফুসফুসে সংক্রমণ হয়। মূলত উপরের অংশে সংক্রমণ হলেও, অনেক সময় ফুসফুসের নীচের অংশেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন নিউমোনিয়া, অ্যাজমা হতে পারে। যাদের ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পুলমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি (COPD) রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ মারাত্মক আকার নিতে পারে।
এই ভাইরাসের কোনও চিকিৎসা নেই বা টিকাও নেই। সাধারণ ঠান্ডা লাগার ওষুধ ও যত্নের মাধ্যমেই রোগীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা হয়।
চিনে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস অনেকটা করোনা ভাইরাসের মতোই। এর প্রতিরোধের উপায়ও তাই করোনাকালে নিয়মবিধির মতো। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সংক্রমণ এড়াতে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধোয়া উচিত। নিয়মিত হাত ধোয়া, চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে বলা হয়।
যাদের ঠান্ডা লাগার মতো উপসর্গ দেখা দিয়েছে, চিকিৎসকরা তাদের মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢাকা উচিত। নিয়মিত হাত ধোয়াও প্রয়োজন।
করোনা ভাইরাস যেমন বিশ্বজুড়ে মহামারির আকার ধারণ করেছিল, তেমনই এই ভাইরাসও মহামারির আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা বহু মানুষের। এবং এই আশঙ্কা অমূলক নয়, কারণ করোনার মতো এই ভাইরাসেরও কোনও ওষুধ বা টিকা নেই। চিনে ইতিমধ্যেই ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে এই সংক্রমণ। হাসপাতালগুলিতে উপচে পড়া ভিড়। রোগীমৃত্যুও বাড়ছে। যদিও চিনা প্রশাসনের তরফে এই সংক্রমণ নিয়ে এখনও কোনও বিবৃতি জারি করা হয়নি। শুধু পরিস্থিতির উপরে নজর রাখা হচ্ছে বলেই জানানো হয়েছে। অজানা প্যাথোজেন শনাক্ত করতে প্রোটোকল তৈরি করা হচ্ছে। ল্যাবরেটরিতে রিপোর্ট তৈরি ও রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে এই আশ্বাস তো করোনা সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আগেও দিয়েছিল চিন। তারপরের পরিণতি তো সকলেরই জানা।
সামনেই চিনের লুনার নিউ ইয়ার রয়েছে। এই সময়ে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে চিনা নাগরিকরা দেশে ফেরেন নববর্ষ পালন করতে। পরে তারাই আবার কর্মস্থলে ফিরবেন। ঠিক যেমনটা করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে হয়েছিল। সেই সময়ও লুনার নিউ ইয়ারের পরই চিনের পাশাপাশি নানা দেশে করোনা ভাইরাসের হদিস মিলতে শুরু করেছিল। এবারও একই ঘটনা ঘটবে না তো? প্রশ্নটা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।