ঢাকা: বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার অন্য দেশে টাকা পাচার হয়েছে। ২৪ বছর ধরে অবৈধভাবে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার! শেখ হাসিনার শাসনকাল অর্থাত্ ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত নাকি এভাবে দেশের টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাঠানো হয়। এবং এর একটা অংশ পাঠানো হয় ভারতে। তিনদিন আগে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই রিপোর্ট জমা করেছে অন্তবর্তী সরকারের তৈরি করা শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
রিপোর্ট জমা পড়ার পর থেকে স্বভাবতই শুরু হয়েছে আলোড়ন। বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতি থেকে ২৩ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি সরিয়ে নেওয়া বা পাচার করার অভিযোগ! তা হলে কি শেখ হাসিনা সরকার দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী মানি লন্ড্রারিং সংস্থা হয়ে উঠেছিল? ইউনুসের তৈরি কমিটি তো অন্তত তেমনই দাবি করছে।
শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্টে দাবি, আওয়ামি লীগ নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী, প্রবাসী বাংলাদেশি, এমনকী আমলাদের মাধ্যমেও এই বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে। বছরে গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। ভারত ছাড়াও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, আমেরিকা, কানাডা ও মরিশাসের মতো দেশেই বেশিরভাগ টাকা চালান হয়েছে।
শেখ হাসিনার আমলে সত্যিই এত বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে কি না, তার কোনও সদুত্তর নেই। তবে রিপোর্টে যে পরিমাণ টাকা পাচারের কথা বলা হয়েছে, সেটা বিশাল। আর মুশকিল হলো, কালো টাকা, পাচার হওয়া টাকার হিসাব পাওয়া তো অত সহজ নয়। আর সেই কারণেই ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স বা FATF-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্ম। তবে কোন দেশ থেকে কত টাকা পাচার হচ্ছে, আজ পর্যন্ত FATF তার কোনও ঠিকঠাক হিসাব বের করতে পারেনি। আজ বাংলাদেশের শ্বেতপত্র কমিটি দু- আড়াই মাসেই সেটা পেরে গেল?
রিপোর্টের মধ্যে রয়েছে বিস্তর জল। বেশ কয়েকটা অনুমানকে তথ্য বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগটাই অভিযোগ। কোনও প্রমাণ নেই বললেই চলে। সবচেয়ে বড় কথা, গত ২৪ বছরে বাংলাদেশ থেকে যা টাকা পাচার হয়েছে, তার দায় শেখ হাসিনা প্রশাসনের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে শেখ হাসিনা বা তাঁর ঘনিষ্ঠরা কীভাবে যুক্ত তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। কারা এই টাকা পাচার করল, নির্দিষ্ট ভাবে কারা, কারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল? বড়, বড় চুক্তিগুলির ক্ষেত্রে কোথায় কী অনিয়ম হয়েছিল? রিপোর্টে কিচ্ছু নেই। সাংবাদিক সম্মেলনে এনিয়ে প্রশ্নের মুখে কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কিছু বলতেই রাজি হননি।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ২৪ বছরে বাংলাদেশের ব্যাঙ্কে যে ব্যাড লোন হয়েছে, তা দিয়ে ১৪টি মেট্রো রেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেত। ঘটনা হল, দুনিয়ার সব দেশে এই ব্যাড লোন থাকে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ে গড় ব্যাড লোনের পরিমাণ বরং বেশি ছিল। সেটা অবশ্য রিপোর্টে বলা নেই।
দুই, অভিবাসন খাতে হুন্ডিতে লেনদেনের মাধ্যমে সাড়ে ১৩ লক্ষ কোটি টাকা সরানো হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ওভারসিজ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে এই বিপুল টাকা বাংলাদেশের বাইরে পাঠানো হয়। মানে বাংলাদেশ থেকে বাইরে কাজের জন্য লোক যাচ্ছে দেখিয়ে টাকা পাঠানো হয়েছে। অথচ কেউই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চাকরি করতে যাননি। এর ফলে বাংলাদেশ নাকি বিপুল টাকার রেমিট্যান্স হারিয়েছে। অথচ ঘটনা হলো, ২০০৯ থেকে ২০২৩ – এই ২৪ বছরে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স বাবদ পেয়েছে। সেটা কী আকাশ থেকে এল?
প্রসঙ্গত, বিদেশে কর্মরত কোনও নাগরিক যখন সেখান থেকে নিজের দেশে টাকা পাঠান, তাকে রেমিট্যান্স বলা হয়। আর অনেক দেশের কাছেই সেটা বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহের বড় ভরসা এই রেমিট্যান্স।
তিন, শেখ হাসিনার আমলে বিদ্যুত্ উত্পাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার ঢালা হয়েছিল। শ্বেতপত্র কমিটির দাবি, এর ১০ শতাংশও যদি দুর্নীতি হয়েছে ধরে তা হলে পরিমাণ হবে ৩০০ কোটি ডলার। কিন্তু এই ৩০০ বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি হলো কোথায়? স্পষ্ট উত্তর নেই।