তাঁর হরেক নাম। কেউ বলেন, তিন পেয়ে সিসিলিয়ান (ইতালির সিসিলি তাঁর জন্মভিটে), আবার কেউ বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে সর্বকালের বিস্ময় বালক। বিশ্বের একমাত্র ৩ পেয়ে ফুটবলার হিসাবেও পরিচিত তিনি। জীবনের মধ্য গগনে যখন, খ্যাতি ওই ৩ পায়ের নীচেই শরণ নেয়। সে সময়ই এমন বিবিধ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন গ্রেট ‘সাইডশো পারফরমার’ ফ্র্যাঙ্ক লেনটিনি (Frank Lentini)।
শৈশব অভাবে না কাটলেও, অন্ধকারে মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিলেন লেনটিনি। তাঁর শরীরে অস্বাভাবিক গঠন সে সময় সমাজ মেনে নিতে পারেনি। তিনি নাকি ভয়ঙ্কর অভিশাপ ডেকে আনতে পারেন! তাঁকে ‘মনস্টার’ বা দৈত্য বলে খেপাত সহপাঠীরা। অনেকে দেখতেন ঈশ্বরের দূত হিসাবে। অলৌকিক শক্তির ক্ষমতাধারী তিনি। এ সব ঘটনায় চরম অবসাদ ঘনিয়ে আসে তাঁর ওই ছোট্ট মনে। বাধ্য হয়ে লেনটিনিকে মাসির কাছে পাঠিয়ে দেন তাঁর মা-বাবা।
জন্ম ১৮৮৯ সালে ইতালির সিসিলিতে। পরিবারের একমাত্র সন্তান না ১২টির মধ্যে পঞ্চম, তা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কিন্তু লেনটিনির ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই চিকিৎসক বলে দিয়েছিলেন, তাঁর বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক হবে না। ৪ মাস যেতে না যেতেই নিতম্বের পাশ দিয়ে বেরনো অতিরিক্ত পা তাঁর জীবন সংশয়ের কারণ হয়ে ওঠে। চিকিৎসকরা ধরেই নিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে পঙ্গু হয়ে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়বেন। কিন্তু জীবন যে বাঁচার স্রোতের দিকে বয়ে চলে, লেনটিনিই ছিল তার প্রমাণ।
আমৃত্যু শরীরে বয়ে নিয়ে গিয়েছেন ৩টি পা, দুই জোড়া পায়ের পাতা, ১৬টি আঙুল এবং একজোড়া পুরুষাঙ্গ। কিন্তু তারা কখনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি লেনটিনির উত্থানে। বরং আরও দৃঢ় করেছে তাঁকে। ১৯৮৯ সালে বাবার সঙ্গে আমেরিকায় চলে আসে লেনটিনি। বয়স মাত্র নয়। দেখা হয়ে যায় গুইসেপ মাগনানো নামে এক প্রফেশনাল শোম্যানের সঙ্গে। ওই ছোট্ট বালককে দেখেই তাঁর মনে ধরে। তাঁকে সার্কাসে ভর্তি করে দিতে লেনটিনির বাবার কাছে আর্জি জানান মাগনানো। এরপরই জীবন মোড় নেয় অন্যদিকে।
বিশ্ব বিখ্যাত রিংলিং ব্রাদার্স সার্কাসে এক বছরের মধ্যেই অন্যতম পারফরমার হিসাবে জায়গা করে নেন লেনটিনি। ওই ৩ পা নিয়ে ফুটবল খেলা, সাইকেলিং, স্কেটিং, দড়ির উপর থেকে ঝাঁপ দেওয়া- এ সব রোমাঞ্চ তৈরি করত দর্শকদের মনে। রাতারাতি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে লেনটিনির। তাঁর প্রেমে পড়েন মার্কিন অভিনেত্রী থেরেসা মুরে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯০৭ সালে। তাঁদের ৪ সন্তান হয়। চার দশক দাম্পত্য জীবন কাটানোর পর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তবে, লেনটিনির প্রেমে ইতি পড়েনি কোনও দিন। হেলেন শুপ নামে এক মহিলার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন লেনটিনি। ১৯৬৬ সালে ফুসফুস সংক্রমণে মৃত্যু হয় তাঁর।
ভ্রমণ পিপাসু ছিলেন লেনটিনি।। গোটা আমেরিকা ঘুরে লেনটিনির উপলব্ধি ছিল, জীবনকে নিয়ে মসকরা করা ভীষণ দরকার। বিভিন্ন সময়ে তাঁকে নিয়ে বিদ্রুপ করা হলে মজার ছলে উত্তর দিতেন তিনি। দাম্পত্য জীবনে তাঁর তৃতীয় পা কোনও বাধা সৃষ্টি করে কিনা, সাক্ষাৎকারে এমন টিপ্পনী করা হলে উত্তর দিতেন রসিয়ে। সবসময় তিনি বলতেন, ‘কারোর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই। আমি মনে করি, জীবন অতি সুন্দর। প্রতি মুহূর্তে বাঁচা উচিত।’ শেষে বলে রাখি, তিনি কখনও চেয়ারে বসতেন না। জীবনের অন্যতম খুঁটি ছিল তাঁর এই তৃতীয় পা-ই।