প্র দী প চ ক্র ব র্ত্তী
ফুটবল। এই খেলার সঙ্গে অনেক আবেগ জড়িয়ে। গোলাকৃতির একটি বলের পিছনে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালবাসা জড়িত। তবে তথাকথিতভাবে ফুটবল বলতে আমরা যা বুঝি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই সংজ্ঞাটা আলাদা। আমেরিকাতে রাগবিকে ফুটবল বলা হয়। সাধারণভাবে আমরা যাকে ফুটবল বলি, মার্কিনীরা তাকে বলে ‘সকার’। কিন্তু, মার্কিন প্রশাসনে ফুটবল শব্দের মানে আলাদা। এই ফুটবলের সঙ্গে খেলার কোনও সম্পর্ক নেই। এই ‘ফুটবল’ একটি চামড়ার ঝোলা। তার ভিতরে থাকে অ্যালুমিনিয়ামের মোটা ফ্রেম থাকে। ওই মোটা ফ্রেমের ভিতরে কী থাকে? তা জানলে অনেকেই অবাক হবেন অনেকে, তবে ভিতরে থাকা বস্তুর সঙ্গে অবশ্যই ফুটবল নামের সাদৃশ্য রয়েছে। ওই পদার্থের নাম নিউক্লিয়ার ফুটবল (Nuclear Football) বা অ্যাটমিক ফুটবল (Atomic Football)। ওই নিউক্লিয়ার ফুটবলই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সর্বক্ষণের সঙ্গী। নিউক্লিয়ার ফুটবলে চারটি জিনিস থাকে। তার প্রথম উপাদানটিই হল ব্ল্যাকবুক। আড়ে বহরে বারো ইঞ্চি ব্ল্যাকবুকে পঁচাত্তরটি পাতা রয়েছে। ওই ব্ল্যাকবুকেই লেখা রয়েছে বিশ্বের কোথায় কোথায় মার্কিন পরমাণু অস্ত্র রয়েছে এবং সেই পরমাণু অস্ত্র গুলির শক্তির বিস্তারিত বিবরণও দেওয়া রয়েছে। ব্ল্যাকবুকে একটি ছোট ফোল্ডারও রয়েছে। পরমাণু যুদ্ধে পৃথিবী ধ্বংসের দিকে গেলে অথবা আমেরিকা কোনও মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে, দেশেবাসীর উদ্দেশে কী বার্তা দেওয়া হবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সেখানে দেওয়া রয়েছে। পরমাণু যুদ্ধের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিশ্বের কোন কোন সেফ নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়ে সুরক্ষিত রাখা যাবে তারও বিস্তারিত বিবরণও থাকে ওই ফোল্ডারে।
নিউক্লিয়ার ফুটবলে একটি তিন বাই পাঁচ ইঞ্চির কার্ড রয়েছে। তার নাম বিস্কুট। ওই কার্ডেম বিশেষ ‘গোল্ড কোডস্’ রয়েছে। আমেরিকার বানানো পরমাণু অস্ত্রগুলি ব্যবহারের জন্য একটি বিশেষ কোড প্রয়োজন। পরমাণু কোডগুলিকে ‘গোল্ড কোডস্’ বলে। ওই কোডগুলি ছাড়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমেরিকার পরমাণু অস্ত্রগুলি কোথায় কোথায় রয়েছে? বিশ্বের তাবড় তাবড় গুপ্তচর সংস্থার তথ্য বলছে, আমেরিকার কাছে প্রায় ৫ হাজার পরমাণু বোমা রয়েছে। কিন্তু, সেই বিপুল পরমাণু অস্ত্রসম্ভারের পুরোটা আমেরিকায় নেই। রণকৌশলগত কারণেই আমেরিকার ওই বিপুল পরমাণু অস্ত্র ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠবে পৃথিবীর কোন কোন দেশে রয়েছে মার্কিন পরমাণু অস্ত্র? শীতযুদ্ধের সময় আমেরিকার অধিকাংশ বন্ধু দেশে আমেরিকার পরমাণু ঘাঁটি ছিল। ব্রিটেন ও গ্রিসেও গোপন পরমাণু ঘাঁটি সচল রেখেছিল আমেরিকা। আটের দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং শীতযুদ্ধের অবসান হয়। শীতযুদ্ধ শেষের পর পরমাণু ঘাঁটির সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছিল আমেরিকা। বর্তমানে বিশ্বের ৫টি দেশের ৬ টি ঘাঁটিতে মার্কিন পরমাণু বোমা রয়েছে।
কোন কোন দেশে রয়েছে আমেরিকার গোপন পরমাণু ঘাঁটি?
স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ্যে সেই তথ্য ঘোষণা করবেনা না। রাশিয়ান গোয়েন্দাদের দাবি, ওই পাঁচ দেশের নাম তাঁরা। জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও তুরস্কে রয়েছে মার্কিন পরামাণু ঘাঁটি। দীর্ঘ বন্ধুত্বের কারণে ইউরোপের এই ৫ দেশকে মার্কিন পরমাণু অস্ত্র সুরক্ষিতভাবে রাখার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। বেলজিয়ামের ক্লেইন ব্রোজেল, জার্মানির বুখেল, ইটালির অ্যাভিয়ানো ও ঘেদি বিমানঘাঁটি, নেদারল্যান্ডসের ভলকেল, তুরস্কের ইনসিরলিকেও মার্কিন পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। এই দেশগুলিতে মজুত পরমাণু বোমার সংখ্যা একশোরও বেশি। প্রতি ঘাঁটিতেই মাটির নীচে বাঙ্কারে রয়েছে মার্কিন পরমাণু বোমা। বাঙ্কারের মধ্যে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ভল্টে পরমাণু অস্ত্র সুরক্ষিত ভাবে রেখেছে মার্কিনরা। ভল্টের দরজা খোলার গোপন কোড শুধু আমেরিকার কাছেই থাকে। মানে ওই বিশেষ ‘ফুটবলে’। বাঙ্কারগুলির দরজার গোপন কোড থাকে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভর মার্কিন প্রেসিডেন্ট আমেরিকা থেকেই যে কোনও ভল্টের দরজা খুলতে পারেন। প্রয়োজনে ওই পরমাণু অস্ত্র কোনও বিশেষ বিমানে করে আমেরিকাতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত কখনও পরমাণু অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
কোন কোন দেশে রয়েছে মার্কিন পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার?
ইউরোপের পাঁচটি দেশ ছাড়াও ন্যাটো সদস্য দেশগুলি মার্কিন পরমাণু অস্ত্রের নিরাপত্তা পায়। সেই দেশগুলির মধ্যে, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, গ্রিস, হাঙ্গেরি, নরওয়ে, পোল্যান্ড ও রোমানিয়াও রয়েছে। শীতযুদ্ধের চরম সময়, ১৯৭১ সালে, গোটা ইউরোপে প্রায় ৭ হাজার ১০০ পরমাণু অস্ত্র ছিল আমেরিকার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সেই সংখ্যা ৯৮ শতাংশ কমিয়ে ফেলা হয়েছিল। কোন ধরনের পরমাণু বোমা ইউরোপে মজুত রেখেছে আমেরিকা? B61-3 সিরিজের পরমাণু বোমা, যা মাটির নীচে বাঙ্কারও ধ্বংস করতে পারে। তবে সব পরামাণু শক্তিধর দেশের মতোই আমেরিকারও দাবি, যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই তাদের এই বিপুল পরমাণু সম্ভার।
হঠাৎ করেই পরমাণু যুদ্ধের প্রয়োজন হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কী করবেন?
নিউক্লিয়ার ফুটবল বা ব্যাগটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সর্বক্ষণের সঙ্গী। অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হলে তিনি সহকারীকে ব্যাগটি খুলতে বলবেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টই মার্কিন সেনাবাহিনীর সর্বময় কর্তা। তিনি পরমাণু অস্ত্রপ্রয়োগের নির্দেশ দিলেই, তিন বাহিনীর প্রধানদের কাছে বার্তা পৌঁছবে। তারপর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এবং বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে দ্রুত বৈঠক সেরে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন প্রেসিডেন্ট। শত্রু, পরিস্থিতি এবং গুরুত্ব বিচার করে পরমাণু হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যদি জরুরি পরিস্থিতি না হয়, অর্থাত্ যদি আমেরিকা আক্রান্ত না হয়ে থাকে তাহলে কী হবে? আমেরিকা যদি নিজের থেকে পরমাণু হামলা করতে চায় তাহলেও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। কখন কোনও প্রেসিডেন্ট ভুলবশত পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের নির্দেশ দিয়ে ফেলতে পারেন। সেই পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমেরিকার ‘টু ম্যান রুল’ (Two Man Rule) রয়েছে। অর্থাত্ প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দেওয়ার পরও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনি সত্যিই ওই নির্দেশ দিয়েছেন কি না। প্রেসিডেন্ট ফের নির্দিষ্ট করে বললে তবেই তা কার্যকর করা হবে। প্রতিরক্ষা সচিব মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশকে খারিজ করতে পারবেন না। যদিও মার্কিন আইনে বলা রয়েছে, সেনাবাহিনী কোনও বেআইনি যুদ্ধ লড়তে পারবে না এবং বেআইনি যুদ্ধে জড়ানোর চেষ্টা হলে, সেনাবাহিনীর তা প্রত্যাখ্যানের সাংবিধানিক অধিকার আছে। সেইজন্যই হয়তো আমেরিকা প্রতি যুদ্ধের একটা অজুহাত খাড়া করে। যাতে সেই সিদ্ধান্তকে কেউ আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। এটাও সত্যি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা এখনও পর্যন্ত প্রায় দুশো যুদ্ধ লড়েছে। তবে এই বিতর্কে না ঢোকাই ভাল। মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রসঙ্গেই ফিরে আসা যাক। যদি প্রেসিডেন্টকে খুন করা হয় অথবা তিনি দুর্ঘটনায় মারা যায়, অথবা অচেতন হয়ে যান? তাহলে প্রতিরক্ষা সচিবই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী হবেন।
আরও পড়ুন Russia-Ukraine Conflict: খোদ রাশিয়া থেকে এল সাহায্য! জ়েলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনা বানচাল