In depth: ময়নাতদন্ত: ‘আকাঙ্খা’কে ছাপিয়ে গেল ‘উদ্বেগ’, কাজে লাগালেন ট্রাম্প
আশাবাদে মার্কিন জনতাকে টেনেছিলেন ওবামা। কিন্তু, ট্রাম্প বুঝেছিলেন সেটা ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষার যুগ। মানুষ বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু, এটা উদ্বেগের যুগ। মানুষের এই উদ্বেগকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। কীভাবে ফের জিতলেন ট্রাম্প? পড়ুন ময়নাতদন্ত রিপোর্ট।
২০১৬ সালে যখন প্রথমবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, চমকে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছিল, না জেনে ভুল করে ফেলেছে মার্কিন জনতা। এবার আর সেই অজুহাত দেওয়ার জায়গা নেই। আমেরিকা জানত যে তিনি একজন দোষী সাব্যস্ত হওয়া অপরাধী। কথায় কথায় মিথ্য়া বলেন। তিনি বর্ণবিদ্বেষী। সবথেকে বড় কথা, চার বছর আগে তিনি গণতান্ত্রিকভাবে জয়ী সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছিলেন। জো বাইডেনের কাছে পরাজয় এবং তারপর ক্যাপিটলে হামলা – বস্তুত চার বছর আগেই ট্রাম্পের রাজনৈতিক কেরিয়ার শেষ হতে বসেছিল। উল্টোদিকে, কমলা হ্যারিসের মধ্যে, আমেরিকা তাদের ২৪৮ বছরের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিল। তারপরও কীভাবে ভোটের ফলে ঘটে গেল ম্যাজিক? কীভাবে চার বছরের মধ্যে ফের হোয়াইট হাউসে ফিরে এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?
অনুগত সমর্থক শিবির
ট্রাম্পের একটা শক্তিশালী অনুগত সমর্থক বাহিনী রয়েছে। যারা তাঁকে প্রায় ধর্মগুরুর চোখে দেখে। তাদের চোখে ট্রাম্প কোনও ভুল করতে পারেন না। ট্রাম্পের এই সমর্থক গোষ্ঠী তাঁর পুরো প্রচারে যুক্ত ছিল। তারাই ট্রাম্পের প্রচারকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। রিপাবলিকানদের পক্ষে বিপুল ভোট পড়া নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর থেকেই ট্রাম্প এই অনুগত সমর্থকদের সহায়তা পেয়েছেন। সেই সমর্থনের ভিত্তিটা আট বছর পরও একই জায়গায় রয়ে গিয়েছে। তিনি যতই বিতর্ক ও সমালোচনার মুখোমুখি হোন না কেন, ট্রাম্পের সমর্থকরা তাঁর পক্ষ ছাড়েনি। ২০২০ সালের পরাজয়ও তাদের উৎসাহে জল ঢালতে পারেনি। ট্রাম্প সমর্থকদের এই উত্সাহ, অনেক ভোটারকে বুথে টেনে এনেছে। অন্যথায় তারা হয়তো ভোট দিতে যেতই না।
গ্রামীণ ভোটারদের সমর্থন
গ্রামীণ আমেরিকায় গত কয়েক দশক ধরেই বেশি ভোট পায় রিপাব্লিকানরা। ২০১৬ সালে শ্বেতাঙ্গ গ্রামীণ ভোটাররাই ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে পাঠিয়েছিলেন। ২০২৪ সালেও তা আবার ঘটেছে। ট্রাম্প সমর্থকদের প্রচারে গ্রামীণ ভোটাররা বিপুল পরিমাণে ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে। সুইং স্টেট, অর্থাৎ, যে রাজ্যগুলিতে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাব্লিকান – দুই পক্ষেরই জয়ের সম্ভাবনা থাকে, এমন সাতটি রাজ্যে ট্রাম্প ২০২০ সালের তুলনায় অনেক বেশি ভোট পেয়েছেন। আসলে, গ্রামীণ ভোটারদের চোখে দীর্ঘকাল ধরেই ডেমোক্র্যাটরা উদারপন্থী অভিজাতদের দল হিসেবে পরিচিত। প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও এবং প্রচার চালিয়েও, সেই ধারণাকে ভাঙতে পারেনি কমলা হ্যারিসের দল। এর পাশাপাশি, শহুরে ভোটার, যারা মূলত ডেমোক্র্যাটদের জয়ের চাবিকাঠি, তারা অনেকেই ভোট দেননি।
সংখ্যালঘুদের মধ্যে সমর্থন বৃদ্ধি
দীর্ঘদিন ধরে ডেমোক্র্যাটদের অন্যতম ভোটব্যাঙ্ক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলি। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গরা ঐতিহ্যগতভাবে তাদেরকেই সমর্থন করে এসেছে। তবে এইবার, ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের সেই ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসিয়েছেন। ট্রাম্প এবার যত অ-শ্বেতাঙ্গ ভোট পেয়েছেন, গত ৪০ বছরে আর কোনও রিপাবলিকান প্রার্থী তা পাননি। জর্জিয়ার বাল্ডউইন কাউন্টির কথাই ধরা যাক। ৪০ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান ভোটারের এই কাউন্টিকে ডেমোক্র্যাটদের দুর্গ বলা হয়। এবার সেখানেও জয় পেয়েছেন ট্রাম্প। হিস্পানিক ভোটের একটা বড় অংশ তার পক্ষে আসায়,নেভাদা এবং অ্যারিজোনা রাজ্যও তাঁর দখলে এসেছে।
ট্রাম্প কার্ড নন মহিলারা
গ্রামীণ আমেরিকা এবং সংখ্যালঘু উভয়ের মধ্যেই, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন বেড়েছে মূলত পুরুষ ভোটারদের জন্য। বুথ ফেত সমীক্ষাতেও তা ধরা পড়েছিল। উল্টোদিকে কমলা হ্যারিস বাজি ধরেছিলেন মহিলা ভোটারদের উপর। ২০২২-এ মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে, গর্ভপাতের অধিকার মার্কিন রাজনীতিতে অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কমলা ছিলেন গর্ভপাতের অধিকারের সোচ্চার সমর্থক। তিনি ভেবেছিলেন এটাই তাঁর তুরুপের তাস হতে চলেছে। ভেবেছিলেন, জাতি, রাজনৈতিক রঙ নির্বিশেষে, মহিলারা তাঁকে ভোট দেবেন। কিন্তু, ভোটে সামগ্রিকভাবে পুরুষ ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প ২২ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে, মহিলা ভোটারদের মধ্যে কমলা মাত্র ১৪ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছেন। আমেরিকায় সাধারণত, মহিলা ভোটারদের সংখ্যা পুরুষদের থেকে বেশি থাকে। এবার তা হয়নি। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের ভোট ধরে রেখেছেন ট্রাম্প।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা
জো বাইডেন প্রশাসন নিয়ে জনগণের মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি হয়েছে বুঝে, নির্বাচনের মাত্র ১০০ দিন আগে কমলা হ্যারিসকে প্রার্থী করেছিল ডেমোক্র্যাটরা। তবে, তাতে মৌলিক কোনও পরিবর্তন হয়নি। আসলে, ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলে, ক্ষমতাসীনদের জেতাটা কঠিন হয়ে যায়। জো বাইডেনের গত চার বছরের শাসনে, যেভাবে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, বেকারত্ব বেড়েছে এবং অর্থনীতিতে তীব্র মন্দা দেখা দিয়েছে, বহু আমেরিকানের জীবনই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। সমস্যাগুলির মূলে ছিল কোভিড মহামারি। হয়তো বাইডেনের করার কিছু ছিল না। কিন্তু, তাদের দুরবস্থার দায় বাইডেনের ঘাড়েই চাপিয়েছে মার্কিন ভোটাররা। অনেকেই ট্রাম্পের আমলই ভাল ছিল বলে মনে করতে শুরু করেছিলেন। সেই সময় যে ৪ লক্ষ মার্কিনির করোনভাইরাসে মৃত্যু হয়েছিল, চাকরির বাজার সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল, মার্কিন জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা ছিল, তা তারা অনেকাংশেই ভুলে গিয়েছিল।
অর্থনীতি
প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষাগুলিতে বেরিয়ে এসেছিল, এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল অর্থনীতি। কমলা হ্যারিসের অনেক আগে প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ট্রাম্প। আর তাঁর ফোকাস ছিল অর্থনৈতিক বিষয়গুলিই। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, কর কমানোর মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে ভোটারদের যে উদ্বেগ, তাকে ছুঁতে পেরেছিলেন তিনি। হ্যারিস কোনও পরিবর্তিত কর্মসূচীর প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনননি, যা ভোটারদের আকাঙ্ক্ষাকে সন্তুষ্ট করতে পারে। মূলত অর্থনৈতিক কারণেই ভোটাররা পরিবর্তন আনতে মরিয়া ছিল।
অভিবাসন এবং সীমান্ত সুরক্ষা
অভিবাসন এবং সীমান্ত সুরক্ষার বিষয়ে ট্রাম্প বরাবরই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এবারের নির্বাচনী প্রচারেও তিনি এই দুই বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। সীমান্তে প্রাচীর দেওয়ার যে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সীমান্ত সুরক্ষায় তহবিল বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। রিপাবলিকান ভোটাররা কঠোর অভিবাসন নীতি সমর্থন করে। ট্রাম্প তাঁদের সামনে সফলভাবে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণকে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। ফলে, রিপাবলিকান ভোট ব্যাঙ্ক অক্ষত রাখতে সফল হয়েছেন তিনি।
ডেমোক্র্যাটদের ভণ্ডামি
ডেমোক্র্যাটরা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের গণতন্ত্রকামী, উদারপন্থী দল হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু বাইডেন এমন কিছু পদক্ষেপ করেছেন, যা তাদের পরিচয়ের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। গাজায় হামলার বিষয়ে ইসরায়েলকে ধারাবাহিকভাবে সমর্থন করে গিয়েছে বাইডেনের আমেরিকা। এতে ডেমোক্র্যাট সমর্থকরাই প্রশ্ন তুলেছে, উদারপন্থী বলে দাবি করার পর, কোনও দল কীভাবে প্যালেস্তিনিয় অসামরিক নাগরিকদের গণহত্যাকে সমর্থন করতে পারে? আরব আমেরিকানরা বরাবর ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দেয়। কিন্তু, বাইডেন প্রশাসনের এই পদক্ষেপের পর তারা ডেমোক্র্যাটদের ভন্ড হিসেবেই দেখতে শুরু করেছে। মিশিগানের ডিয়ারবর্ন শহরে সবথেকে বেশি আরব-আমেরিকানদের বাস। সেখানে মাত্র ৩৯.৬ শতাংশ ভোট পড়েছে।
আশা নয় উদ্বেগ
২০১৬ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। তাঁর প্রচারের মূল শব্দ ছিল ‘হোপ’ অর্থাৎ, আশা। আশাবাদে মার্কিন জনতাকে টেনেছিলেন ওবামা। কিন্তু, ট্রাম্প বুঝেছিলেন সেটা ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষার যুগ। মানুষ বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু, এটা উদ্বেগের যুগ। উচ্চ-আয়ের শ্রমিক শ্রেণি থেকে শুরু করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী, তাদের সামাজিক অবস্থা হারানোর ভয় পাচ্ছে। আর্থিক নিরাপত্তার জন্য তারা আকুল। তরুণরা উদ্বেগে, তাদের বাবা-মায়েরা যে সামাজিক অবস্থানে ছিলেন, তাদের অবস্থা তার থেকে খারাপ হবে। মানুষের এই উদ্বেগকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। শ্বেতাঙ্গদের দুরবস্থার জন্য কৃষ্ণাঙ্গ থেকে অভিবাসীদের দায়ী করেছেন। আর, সেই দুরবস্থা দূর করার জাদুদণ্ড তাঁর হাতেই রয়েছে, এমন এক ধারণা সফলভাবে স্থাপন করত পেরেছেন ভোটারদের মনে।