সময় যত এগোচ্ছে, ততই বাড়ছে ব্যবধান। গণনা শেষ না হলেও, মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল একেবারে পরিষ্কার। বড় সমর্থন নিয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ফলে ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যত, ট্রাম্প ২.০ প্রশাসনে একটি নতুন দিক নিতে পারে। বাণিজ্য থেকে অভিবাসন, সামরিক সহযোগিতা থেকে কূটনীতি – বিভিন্ন দিক জুড়ে ভারতের জন্য যেমন রয়েছে বড় সুযোগ, তেমনই রয়েছে চ্যালেঞ্জও। বাণিজ্য ক্ষেত্রে ভারতের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার সমস্যায় পড়তে পারেন মার্কিন আইটি সংস্থাগুলিতে কর্মরত ভারতীয় কর্মীরা। এরকম বেশ কিছু বদল ঘটতে পারে আগামী কয়েক মাসে। ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে আসায় ভারতের ক্ষতি না লাভ? আসুন দেখে নেওয়া যাক –
ইয়ে দোস্তি…
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প খুবই খামখেয়ালি। তিনি কখন কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা আগে থেকে আন্দাজ করা কঠিন। কাজেই, ট্রাম্পকে নিয়ে ভারতকে সতর্ক থাকতেই হবে। তবে, সব চ্যালেঞ্জকে ছাপিয়ে যেতে পারে নরেন্দ্র মোদী ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক। হিউস্টনের ‘হাউডি, মোদি!’ থেকে আহমেদাবাদের ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর মতো এর হাই-প্রোফাইল ইভেন্টগুলিতে তাদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের ছবি ধরা পড়েছিল। প্রচার পর্বেও ট্রাম্প বারংবার নরেন্দ্র মোদীকে ‘মহান ব্যক্তি’, ‘মহান নেতা’, ‘ভাল বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে দুই রাষ্ট্রনেতার এই বন্ধুত্বই ভারত-মার্কিন সম্পর্কের মূল ভিত্তি ছিল। কাজেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্পের সময় ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বিশেষ করে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক আরও বাড়তে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। কানাডার বুকে খালিস্তানি নেতার হত্যাকে কেন্দ্র করে, বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে যে মন কষাকষি চলছিল, তারও অবসান ঘটাতে পারে মোদী-ট্রাম্প দোস্তি।
বাণিজ্য
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের যে দিকটি সবথেকে বেশি প্রভাবিত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, তা হল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। বাইডেন প্রশাসনের সময়ই আমেরিকার ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। এর লক্ষ্য, চিন থেকে ভারতের মতো আরও সুবিধাজনক দেশে সরবরাহ চেইনকে স্থানান্তর করা। এই নীতি ট্রাম্পের আমলে আরও গতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রচার পর্বে ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি চিনকে বাণিজ্য ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে চান। তার জন্য তিনি চিনে তৈরি পণ্যের উপর নতুন করে শুল্ক চাপাবেন। এর ফলে, আরও অনেক মার্কিন সংস্থা তাদের উত্পাদন কেন্দ্র চিন থেকে ভারতে স্থানান্তর করতে পারে। নয়া উত্পাদন কেন্দ্র হিসাবে বিশ্বের বুকে নিজেকে স্থাপন করার পথ খুলে যেতে পারে ভারতের সামনে। আর সেটা হলে ভারতের বিশ্বগুরু হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
তবে, তিনি একইসঙ্গে পারস্পরিক কর আরোপের অঙ্গীকারও করেছেন। অর্থাৎ, কোনও দেশ মার্কিন পণ্যের উপর কর ধার্ষ করলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সেই দেশের পণ্যের উপর সমমানের কর ধার্য করবে। তিনি ভারতকে ‘বিশ্বের সবথেকে বড় শুল্ক ধার্যকারী’ও বলেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন যদি এই শুল্ক নীতি গ্রহণ করে, সেই ক্ষেত্রে ভারতের তথ্য প্রযুক্তি, ওষুধ শিল্প এবং বস্ত্রশিল্পর মতো ক্ষেত্রগুলিতে বড় প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এই শিল্পক্ষেত্রগুলি অনেকাংশেই মার্কিন বাজারের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া, ভারতকে বাণিজ্য বাধা কমানোর জন্যও চাপ দিতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছে প্রতিরক্ষা এবং সামরিক সহযোগিতা। বাইডেন প্রশাসনের সময়ে, ইনিশিয়েটিভ অন ক্রিটিকাল অ্যান্ড এমার্জিং টেকনোলজি বা আইসিইটি এবং জেট ইঞ্জিন তৈরির জন্য জিই-হ্যাল চুক্তির মতো বেশ কিছু প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে, ট্রাম্প তাঁর বিদেশ নীতিতে মার্কিন স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেন এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির জট কমানোর চেষ্টা করেন। প্রথম মেয়াদে, তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং ইরান পারমাণবিক -সহ গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বা সংশোধন করেছিলেন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে, ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তিগুলিও ব্যাহত হতে পারে। সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে পারেন ট্রাম্প।
তবে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের দাদাগিরির মোকাবিলার যদিও ভারত-মার্কিন সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেই আশা করা যায়। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেই নয়া উচ্চতাও দেখা গিয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার জোট কোয়াড-কে। নয়া ট্রাম্প প্রশাসনে, অস্ত্র বিক্রি, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং যৌথ সামরিক মহড়ার মতো বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দেখা যেতে পারে।
অন্যদিকে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ট্রাম্পের নীতি হল ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’। অর্থাৎ, অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কড়া হাতে মোকাবিলায় বিশ্বাসী তিনি। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি, মোদী সরকারের নিরাপত্তা নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরেই ভারত চায়, পাকিস্তানের প্রতি কঠোর অবস্থান নিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে, আমেরিকা অনেকাংশেই পাকিস্তানের পাশ থেকে সরে এসেছিল। ট্রাম্পের সেই অবস্থান বদলাবে না বলেই মনে হয়।
ভিসা নীতি
একটা বিষয়েই ভারত-মার্কিন সম্পর্কের তাল কাটতে পারে। প্রথম মেয়াদে অভিবাসন বিষয়ে বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি করেছিলেন ট্রাম্প, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছিল ভারতীয় কর্মশক্তির উপর। বিশেষ করে, এইচ-১বি (H-1B) ভিসা প্রোগ্রামে প্রচুর সীমাবদ্ধতা টানার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই ভিসাই বিদেশিদের আমেরিকার মাটিতে কাজ করার অনুমতি দেয়। এই ভিসা পাওয়ার যোগ্যতার মানদণ্ড কঠোর করেছিলেন ট্রাম্প। আবেদনপত্রগুলির যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াতেও কড়াকড়ি আনা হয়েছিল। যার ফলে সমস্যায় পড়েছিলেন ভারতীয় তথ্য-প্রযুক্তি পেশাদার এবং প্রযুক্তি সংস্থাগুলি।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এই বিষয় আরও কড়াকড়ি দেখা যেতে পারে। যেমন এইচ-১বি ভিসাধারীদের বেশি পরিমাণে মজুরি দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে সংস্থাগুলি স্বাভাবিকভাবেই বিদেশিদের বদলে মার্কিন কর্মীদের নিয়োগ করতে বেশি উৎসাহিত হবে। এছাড়া, এইচ-১বি ভিসার সংখ্যাও কমাবনো হতে পারে। শুধুমাত্র বড় ডিগ্রিধারী বা বিশেষ দক্ষতাসম্পন্নদেরই এই ভিসা মঞ্জুর করা হবে, এমন নিয়ম জারি করা হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে করাটা করাটা ভারতীয়দের পক্ষে সমস্যার হতে পারে।