ব্যাঙ্কক: অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যৌন অপরাধীরা ‘হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার’ অর্থাৎ স্বভাবগতভাবে অপরাধী হয়। একবার অপরাধ করে ধরা পড়লেও, ছাড়া পাওয়ার পর ফের তারা সেই একই অপরাধ করে বসে। তাই যৌন অপরাধের মোকাবিলা করার জন্য, যৌন অপরাধীদের উপর এবার ‘কেমিক্যাল কাস্ট্রেশন’ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চলেছে থাইল্যান্ড। অর্থাৎ, অপরাধীদের শরীরের একটি রাসায়নিক প্রয়োগ করে, তাদের যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া হবে। তবে, এই ব্যবস্থাটি বেছে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হবে অপরাধীদর। কারাদণ্ডের মতো সাজা কমানোর বিনিময়ে এই পদ্ধতিটি বেছে নিতে পারবে তারা।
মঙ্গলবার এই বিষয়ে থাই সংসদের উচ্চকক্ষ বা সেনেটে একটি বিল পাস হয়েছে। এই বিল যৌন অপরাধীদের স্বেচ্ছায় রাসায়নিক প্রয়োগে বন্ধাত্ব বেছে নেওয়ার অনুমতি দেবে। গত মার্চ মাসেই থাই সংসদের নিম্নকক্ষে এই বিলটি পাস হয়েছিল। মঙ্গলবার, ১৪৫ জন সেনেটর সর্বসম্মতিক্রমে বিলটিকে অনুমোদন দিয়েছেন। দুজন সেনেটর অবশ্য ভোট দেননি। অবশ্য এই বিলটি আইনে পরিণত হতে গেলে, এখনও দুটি ধাপ পার করতে হবে। এরপর লাগবে মন্ত্রিসভার অনুমতি, সবশেষে থাই রাজার অনুমোদন।
‘কেমিক্যাল কাস্ট্রেশন’ হল এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে যৌন কামনা কমানোর জন্য একটি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত লিউপ্রোলাইড অ্যাসিটেট নামক একটি রাসায়নিক, ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করানো হয়। ফলে ওই ব্যক্তির শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যায়। ফলে তাদের যৌন ক্ষমতা এবং যৌন কামনা দুইই কমে। খসড়া আইন অনুসারে, যৌন অপরাধীদের ১০ বছরের জন্য পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তাদের ইলেকট্রনিক মনিটরিং ব্রেসলেট পরতে হবে। এই ওষুধ প্রয়োগ করা হবে সংশ্লিষ্ট যৌন অপরাধীর অনুমতি সাপেক্ষে। এছাড়া একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা একজন ইন্টারনাল মেডিসিনের ডাক্তার বা উভয়ের সম্মতি লাগবে। কীভাবে ‘কেমিক্যাল কাস্ট্রেশন’ করা হবে, তা থাই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। বিল অনুযায়ী, অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটা আটকাতে অপরাধীদের সাজা দেওয়ার পরে বা যারা পুনর্বাসনে আছে তাদের ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থা প্রয়োগ করা যাবে।
থাই সংশোধনাগার বিভাগের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে থাই কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে মোট ১৬,৪১৩ জন যৌন অপরাধী। এদের মধ্যে ৪,৮৪৮ জন ফের যৌন অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। থাই আইন মন্ত্রী সোমসাক থেপসুথিনের মতে এই চিকিত্সা অপরাধীদের ফের অপরাধ করার পরিসংখ্যান উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে। তিনি বলেছেন, ‘আমি চাই এই আইনটি দ্রুত পাস হোক। আবার মহিলাদের সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেছে, এমন খবর আমি দেখতে চাই না।’
যৌন অপরাধীদের যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া নতুন কিছু নয়। নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং জার্মানিতে গুরুতর যৌন অপরাধীদের অস্ত্রোপচার করে বন্ধা করে দেওয়া হয়। আর রাসায়নিক প্রয়োগে যৌন ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পদ্ধতি চালু রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, এস্তোনিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি রাজ্য-সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে। অস্ত্রোপচার করে কাউকে বন্ধা করে দেওয়া, আর রাসায়নিক প্রয়োগ করা – দুইয়ের মধ্যে বিশেষ তফাৎ হয় না বলেই জানিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। ২০১২-তে ব্রিটেনে প্রায় একশ জন বিপজ্জনক শিশু নিগ্রহকারী তাদের সাজা কমানোর বিনিময়ে রাসায়নিক প্রয়োগে বন্ধাত্ব গ্রহণ করেছিল। রাসায়নিক কাস্ট্রেশনের কারণেই স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় যৌন অপরাধীদের পুনরায় অপরাধ করার হার ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে বলে দাবি করা হয়।
তবে এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বিতর্কিত। মানবাধিকার কর্মীদের একাংশের দাবি, এই প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। পাশাপাশি, যৌন অপরাধ কমানোর ক্ষেত্রে তেমন কার্যকরও নয়। তাঁরা মনে করেন, রাসায়নিক প্রয়োগে যৌন ক্ষমতা কেড়ে নিলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আচরণ অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তাঁর মধ্যে আরও হিংস্রতার সঞ্চার হতে পারে। বন্ধা ব্যক্তিটির তীব্র ক্রোধ বর্ষাতে পারে মহিলাদের উপরে। তাছাড়া সহবাসই হিংসার একমাত্র মাধ্যম নয়। মেয়েদের প্রতি হিংসা প্রদর্শন যারা করে, তারা হিংসা প্রকাশের অন্যান্য উপায় খুঁজে নিতেই পারে। মানবাধিকার কর্মীদের আরও দাবি, মৃত্যুদন্ড বা ইনজেকশন দিয়ে যৌন ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার মতো শাস্তি ব্যবহার করলে, অপরাধীদের সংশোধন হয় না, এমন ধারণাই শক্তিশালী হবে।